পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে তামাকের বিষ
মানিক মুনতাসির : তামাকের খেতে ছেয়ে গেছে পার্বত্য এলাকা চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রতি বছরই তামাক চাষের পরিমাণ বাড়ছে এ অঞ্চলে। কমছে ভুট্টা, সবজি ও ফলমূল চাষ। আর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা ছেয়ে গেছে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ চুল্লিতে। যা পুরো উপজেলাকে গ্রাস করে ফেলেছে। তামাক চাষের পাশাপাশি তামাক পণ্য সেবনের মাত্রাও প্রতিনিয়তই বাড়ছে এ পার্বত্য অঞ্চলে। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এমন দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। আর তামাক পণ্য সেবনের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে এ অঞ্চলের মানুষের। সেই সঙ্গে পাহাড়ি এলাকার পরিবেশ দূষণও বাড়ছে সমানতালে। যা পাহাড়ি এলাকার ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, বিভিন্ন তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানি নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে উৎসাহী করছেন পাহাড়বাসীকে। সেক্ষেত্রে ভুট্টা, সবজি বা অন্য ফসল ফলানোর পরিবর্তে তামাক চাষ করলে বীজ, সার, সেচ দেওয়ার খরচ, নিড়ানি খরচসহ সব ধরনের আগাম সহায়তা দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। ফলে পাহাড়ি এলাকার মানুষ অধিক লাভের আশায় তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। যদিও সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে ভুট্টা, পাতাকপি, ফুলকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি, তরমুজসহ বিভিন্ন ধরনের ফল চাষের জন্য স্থানীয় কৃষকদের সহায়তা দিয়ে আসছে। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে অবাধে পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে তামাক চাষ করা হচ্ছে। আবার পাহাড়ের পাদদেশেই নতুন নতুন বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও। ফলে প্রতি বছরই বর্ষাকালে কম-বেশি পাহাড় বা ভূমি ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে দুই পাহাড়ে মাঝ দিয়ে পিচঢালা পথের পাশ দিয়ে পাহাড় কেটে তামাক চাষ করা হচ্ছে। আবার প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গহিন জঙ্গলের ভিতরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তামাক চাষ করা হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, দীঘিনালার ফসলি জমিতে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে তামাকের চাষ। প্রান্তিক কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করতে তাদের অগ্রিম টাকা ও সার বরাদ্দসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছে বিড়ি, সিগারেট কোম্পানিগুলো। ফলে কৃষকরা সবজি চাষের পরিবর্তে বর্তমানে তামাক চাষে বেশি ঝুঁকছে। উপজেলার শত শত একর জমিতে পূর্বে বিভিন্ন রকমের শীতকালীন সবজি চাষ করা হলেও বর্তমানে বেশির ভাগ জমিতেই চলছে তামাকের চাষ। স্থানীয় তামাক চাষিরা জানান, এক একর জমিতে ধান চাষ করলে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হয়। কিন্তু ওই জমিতে তামাক চাষ করলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানি অগ্রিম টাকা ও বিভিন্ন কীটনাশক দিচ্ছে। এজন্য কৃষকরা ধান কিংবা সবজি চাষ না করে তামাক চাষে ঝুঁকছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা নীলিমা চাকমা জানান, দীঘিনালা লারমা স্কয়ারে বছর কয়েক আগেও শীত মৌসুমে স্বল্প দামে নানা ধরনের সবজি পাওয়া যেত। কিন্তু কয়েক বছরে দীঘিনালাসহ পাহাড়ি অঞ্চলে সবজির জোগান কমে গেছে।
বিভিন্ন এলাকায় তামাক চাষের কারণে বিভিন্ন সবজির দাম অনেক বেশি। একই দৃশ্য চোখে পড়েছে চট্টগ্রামের রাউজান, বান্দরবান ও রাঙামাটির বিভিন্ন অঞ্চলে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় সবজি চাষ কমে যাচ্ছে। জেলায় তামাক চাষিদের তালিকা করে তাদের তামাক চাষ থেকে বিরত রাখতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন রকম প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। তামাকবিরোধী জোট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক চাষের কারণে সবুজ পাহাড় বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। ক্ষতিকর জেনেও তামাক চাষ থেকে বাদ যাচ্ছে না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশের জমি ও জনবসতিপূর্ণ এলাকাও। সরকারি হিসাবে তামাক চাষ কমে আসার কথা থাকলেও তামাক চাষের জমি বাড়ছে। তামাক চাষের কারণে শুধু খাগড়াছড়ি জেলাতেই প্রায় দুই সহস্র চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে বনের মূল্যবান কাঠ। অভিযোগ রয়েছে, সবই হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগকে ম্যানেজ করে। অদৃশ্য কারণে যেন তামাক কোম্পানির কাছে সবাই জিম্মি। খাগড়াছড়ির মাইনি চেংগি নদী তীরবর্তী জমিতে ব্যাপক হারে ক্ষতিকর তামাক চাষ হচ্ছে। এর ফলে জমিতে ব্যবহূত কীটনাশক ও তামাকের রাসায়নিক গিয়ে নদী, জলাশয়ের পানিতে মেশায় পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকগুলো পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে সুপেয় পানির উৎস নষ্ট করছে এবং এর ফলে পানিবাহিত রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে মাছের ডিম পাড়ার সময়ে তামাকের কীটনাশক পানির সঙ্গে মেশার ফলে মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্রমে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তামাক পাতার কারণে এমন সব পোকার আগমন ঘটে যা আশপাশের জমির ফসলকে আক্রমণ করে। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে এলাকাবাসীকে সচেতন করা হচ্ছে। এ ছাড়া তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে অন্য ফসলে উৎসাহী করার উদ্যোগ নিচ্ছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
Source: bd-pratidin, 03 November, 2018