সরকারকে তামাক ব্যবসায় চায় কোম্পানিগুলো
২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে (বিএটিবি) থাকা সরকারের অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করাসহ তামাক খাতে সরকারের কোনো বিনিয়োগ না থাকার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এ খাতে সব ধরনের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
সরকারের এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি লিখে সংগঠনটির সভাপতি নাসিরউদ্দিন বিশ্বাস বলেছেন, তামাক উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত যেকোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের সব ধরনের অংশীদারিত্ব, বিনিয়োগ ও প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করা উচিত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন। তার ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, ২০১৯’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর তা জারি করা হবে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার দিনই অর্থমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থ ও স্বাস্থ্য সচিবের কাছে চিঠি লিখে তামাক খাতে সরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছে সিগারেট কোম্পানিগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) কো-অর্ডিনেটর খায়রুল আলম শেখ গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে এ নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সিগারেট কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা আমার কাছে এ ধরনের কোনো চিঠি দেয়নি, অর্থ বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য আমাকে জানানো হয়নি।
তামাকবিরোধী সংস্থা প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালে দেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হলে যেসব দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। তামাক বা সিগারেট কোম্পানিগুলো বরাবরের মতোই এর বিরোধিতা করছে। কারণ তাতে তাদের ব্যবসা কমে যাবে। বিরোধিতা করার সময় তারা সবসময়ই সরকারকে টাকার ‘ভয়’ দেখিয়ে বলে যে, তামাক খাত থেকে বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়। ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাজস্ব আদায় কমবে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, যেসব দেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের সবই এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। তাতে তামাক খাত থেকে রাজস্ব কমলেও অন্য খাত থেকে সরকারগুলো বাড়তি রাজস্ব পেয়েছে। উন্নয়নকাজে অর্থের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে গেলে বাংলাদেশেরও রাজস্ব আয়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক তামাক সেবন করে। এ হিসাবে দেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৯২ লাখ ধূমপানের মাধ্যমে ও ২ কোটি ২০ লাখ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা এ খাত থেকে ওই বছরের রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি। ওই অর্থবছর তামাক থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ৪২ দশমিক ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়। খসড়া নীতিতে তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য স্থির করে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাক ব্যবহার শুরুর প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে জনগণকে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা হবে। ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ২০৩৫ সালের মধ্যেই তামাক উৎপাদন শূন্যের ঘরে নামানো হবে।
তামাকের চাহিদা কমাতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে পর্যায়ক্রমে ৫ শতাংশে উন্নীত করাসহ তামাকপণ্যের দাম প্রতি বছর এমনভাবে বাড়ানো হবে, যাতে তা বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয় বাড়ার যোগফলের চেয়ে বেশি হয়।
তামাকের সরবরাহ কমাতে খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আলাদা নীতিমালা করা হবে। তামাকজাত পণ্য ব্যবসায়ীদের জন্য সুনির্দিষ্ট উচ্চ ফিসহ শর্তারোপ করে লাইসেন্সিং নীতিমালা প্রণয়ন করে লাইসেন্স গ্রহণে বাধ্য করা হবে। ইলেকট্রনিক সিগারেট, ভ্যাপিং, লিকুইড, হিটেডসহ তামাক ব্যবহারে উদ্ভাবিত সব যান্ত্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বিক্রি, উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হবে। তামাক খাতে সব ধরনের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হবে।
বাণিজ্যিক স্বার্থ থেকে সুরক্ষা বিষয়ে এতে বলা হয়েছে, তামাক শিল্প তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে যেকোনো ধরনের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করার মাধ্যমে তামাক ব্যবহার কমানোর প্রবণতা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এ বাস্তবতায় তামাক শিল্প সংশ্লিষ্ট সব বাণিজ্যিক কার্যক্রম এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন যেন এসব গোষ্ঠী কোনোভাবেই তামাক নিয়ন্ত্রণে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে। এজন্য তামাক উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত যেকোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের সব ধরনের অংশীদারিত্ব, বিনিয়োগ, প্রতিনিধিত্ব প্রত্যাহার করাসহ ভবিষ্যতেও তা মেনে চলার কথা বলা হয়েছে।
খসড়া নীতির বিরোধিতা করে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাসিরউদ্দিন বিশ্বাস চিঠিতে লিখেছেন, এ খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বন্ধ হলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তামাক উৎপাদন ও সরবরাহের কাজে জড়িত যেকোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের অংশীদারিত্ব, বিনিয়োগ বা প্রতিনিধিত্ব বাতিল না করে বরং তা সুনিশ্চিত করা উচিত। ইলেকট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধ করার বিরোধিতা করে নাসিরউদ্দিন বলেছেন, তামাকপণ্য বিক্রেতাদের লাইসেন্সিং নীতিমালার আওতায় আনা হলে বিক্রি কমে যাবে। তাতে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে। খসড়া নীতির অন্যান্য বিষয়েও বিরোধিতা করেছেন তিনি। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই তামাক ব্যবসা কমানোর নীতিমালা করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সিগারেট কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে নানা প্রস্তাব দিতেই পারে, কিন্তু সরকার তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করবে।
Source: Deshrupantor, 20 September 2019