তামাক চুল্লি গিলে খাচ্ছে পাহাড়িবন
পরিবেশের ক্ষতির তোয়াক্কা না করে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির প্রায় সব উপজেলায় দেদারসে জ্বলছে তামাকচুল্লি। বনাঞ্চল আর ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের কাঠ কেটে এসব চুল্লিতে পোড়ানো হচ্ছে। তামাক চাষ বন্ধে সরকারিভাবে কোনো আইন বা নিষেধাজ্ঞা না থাকায় চলছে ধ্বংসযজ্ঞ।
তামাক চুল্লিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ধূমঘর। জমি থেকে কাঁচা তামাক পাতা সংগ্রহ করে এনে শুকানো হয় এ তামাক চুল্লিতে।
সূত্রমতে, বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন হিসেবে খ্যাত তামাক চাষ এবার করা হয়েছে প্রায় সাড়ে আটশ’ হেক্টর জমিতে। এ ফসল চাষ বন্ধে কোনো আইন না থাকলেও রয়েছে পরিবেশ আইন। যে আইনে প্রতিবছর হাতে গোনা কয়েকটি তামাক চুল্লিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়। তবে এ ঘটনায় থামানো যায়নি তামাক চুল্লির ভয়াবহতা। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ আর জনপ্রতিনিধিদের রহস্যজনক নীবরতা। অভিযোগ রয়েছে, তামাক চাষে পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রভাবশালীদের ভয়েই মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
সরেজমিনে দীঘিনালা উপজেলার কবাখালি ইউনিয়নের হাচিনসনপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ধূমঘরের অনেক দূর থেকে নাকে ভাসছে তামাক পাতা পোড়ানোর অম্লঘ্রাণ। তবে এ ঘ্রাণে কেউই আঁচ করতে পারছে না মানব শরীরের জন্য এটা কত ক্ষতিকর। আরেকটু সামনে গিয়ে চোখে পড়ে হাচিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাশেই তামাক চুল্লিতে শুকানো হচ্ছে তামাক। চুল্লি থেকে নির্গত ঘ্রাণে কোমলমতি শিশুদের ক্লাসরুমে ক্লাস করতে সমস্যা হয়। কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থী জানান, অনেকেরই মাথা ঝিম ঝিম করে। অনেকই বমি করে ফেলে।
হাচিনসনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চর্তুথ শ্রেণীর ছাত্রী কাজলিকা চাকমা, আল আমিন, এন্টি ত্রিপুরা জানালো, তামাক চুল্লিতে আগুন দেয়া হলে ক্লাস রুমে গন্ধে চলে আসে। ক্লাসে পাঠ নিতে মনোযোগ দিতে পারি না। অনেক সময় মাথা ব্যথা এবং বমি হয়। ক্লাস রুমের এক পাশের জানালা এ কারণেই বন্ধ রাখা হয়। এরপরেও দুর্গন্ধে ক্লাসে থাকতে পারি না।
প্রধান শিক্ষক পঙ্কজ কুমার চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আপনারা তো চলে যাবেন। পরে তামাক চাষীরা আমাকে ধরবে।
তামাক চুল্লিতে জ্বালানি কাঠ ঠেলে দেয়ার কাজ করছেন মাবেয়া বেগম। তবে তার মুখে নেই মাস্ক বা মুখবন্ধের ব্যবস্থা। তিনি জানান, ক্ষতি জেনেও বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয়। কারণ এখান থেকে যে আয় করি তা দিয়েই সংসার আর ঋণ শোধ করতে হয়।
হাচিনপুর গ্রামে রয়েছে পাশাপাশি ১৫-২০টি চুল্লি। এসব চুল্লির আশেপাশেই রয়েছে একটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়। প্রত্যেকটি চুল্লির পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে শত শত মণ কাঠ।
কাঠ সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে চুল্লির মালিক হারুন মিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে সরে পড়েন। পরে এলাকা ঘুরে অন্যান্য চুল্লির মালিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তারা মুখ খোলেননি।
কবাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব কল্যাণ চাকমা বাংলামেইলকে বলেন, যারা তামাক চাষ করে এবং চুল্লি আছে তারা সবাই প্রভাবশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস করে না। গত বছর তামাক চুল্লি এবং কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাকে জানিয়েও দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি।
দীঘিনালার কবাখালী ইউনিয়নের হালচিত্র এমনই। পাশাপাশি মাইনী, মেরু, বোয়ালখালীসহ উপজেলায় প্রায় সাত শত হেক্টর জমিতে এবছর তামাকের চাষ হয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মার্চ পর্যন্ত চলে তামাক পাতা সংগ্রহ ও শুকানোর কাজ। উপজেলায় প্রায় চার শতাধিকের বেশি তামাক চুল্লিতে এখন পাতা শুকানোর কাজ চলছে। পাশাপাশি জেলা সদরের মাইসছড়ি, নুনছড়ি, কমলছড়ি, বিচিতলা এবং মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি উপজেলা সদর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বলছে তামাক চুল্লি আর পুড়ছে কাঠ। আর এসব কাঠ আনা হচ্ছে পাশ্ববর্তী বনাঞ্চল এবং বাগান থেকে। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্য দিকে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত এবং আশপাশের মানুষেরও চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে।
খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ডা. নারায়ণ চন্দ্র দাশ বাংলামেইলকে বলেন, তামাক চাষের ফলে চর্ম, ক্যান্সার এবং যক্ষ্মার মতো রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব রোগ দ্রুত ধরা না পাড়লেও ধীরে ধীরে মানবদেহে ক্ষতি করে।
খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বাংলামেইলকে বলেন, জেলায় তামাকের আবাদ যে হারে বাড়ছে তাতে একদিকে যেমন ফসলি জমি কমছে, অন্যদিকে তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য বনের কাঠ পোড়ানোর হিড়িক পড়ছে। এতে সবুজ পাহাড় ধ্বাংসের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে বন্যপ্রাণীরা।
এবিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান বাংলামেইলকে বলেন, তামাক চাষ বন্ধে সরকারি ভাবে কোনো আইন না থাকায় প্রশাসন কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। তবে তামাক চাষ না করতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চাষীদের নিরুৎসাহ করে যাচ্ছে। ডিসি আরো বলেন, পরিবেশ আইনে তামাক চুল্লিগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাদের নিদের্শ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু স্থানে তামাক চাষ শুরু হলেও ২০০৭ সাল থেকে ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করে। স্থানীয় চাষীরা অন্যান্য ফসলের চেয়ে তামাক চাষে বেশি লাভবান ও ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা থাকায় এতে বেশি করে ঝুঁকে পড়ছেন। তবে বিকল্প কোনো ফসল পেলে ও বিক্রির নিশ্চয়তা থাকলে চাষিরা ক্ষতিকর ফসল চাষ থেকে বিরত থামবে বলে আশা পরিবেশবাদীদের।
Source:বাংলামেইল২৪ডটকম,শুক্রবার, ০৬ মার্চ ২০১৫ ১৫:৪২