বাজেটে সম্পূরক শুল্ক না বাড়ায় সস্তা হচ্ছে তামাক পণ্য
সব পণ্যের দাম বাড়লেও উল্টো চিত্র তামাক পণ্যের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ সস্তা হচ্ছে এসব পণ্য। সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে শুধু মূল্যস্থর এবং ভিত্তিমূল্য সমন্বয় করার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও বাংলাদেশে তামাক পণ্যের দাম সবচেয়ে কম। ফলে লাফিয়ে বাড়ছে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা। আর স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেটে তামাক পণ্যের কর বাড়ানোর বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনকণ্ঠকে বলেন, তামাক পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হবে। প্রতি বছরইত বাড়ে। কিন্তু এবার আরও বাড়বে। তাছাড়া এখনও হাতে সময় আছে। দেখা যাক কতটুকু বাড়ানো যায়।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি, তামাক পণ্যের ওপর অধিকহারে কর বাড়ানোর বিকল্প কিছু নেই। তাছাড়া সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর তুলে দিতে হবে। কেননা, এক ধাপের সিগারেটের দাম বাড়লে মানুষ অন্যটিতে যেতে পারে। এ জন্য যখন সব তামাক পণ্যের দাম বাড়বে তখন এর ব্যবহার কমে আসবে।
২০১২ সালে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিকস অব টোব্যাকো এ্যান্ড টোব্যাকো ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে বাংলাদেশেই সিগারেটের দাম সবচেয়ে কম। বিড়ির দাম আরও কম। বলা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য অর্থাৎ অন্যান্য পণ্যের মূল্যের তুলনায় ক্রমাগত কমছে। অন্যদিকে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে এবং এভাবে তামাক পণ্য ক্রমশ আরও বেশি পরিমাণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসছে। তাছাড়া তামাক পণ্যের জটিল কর কাঠামোর কারণে কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করছে তামাক কোম্পানিগুলোকে। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
এক্ষেত্রে বলা হয়েছে সিগারেটের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর ভিত্তিক কর কাঠামো, ভিন্ন ভিন্ন মূল্যস্তরের ওপর ভিন্ন ভিন্ন হারে শতাংশ হিসেবে (এ্যাড ভ্যালোরেম) কর, ভ্যাট ও করারোপে জটিল ভিত্তি এসব তামাক পণ্যের কর কাঠামোকে জটিল করে তুলেছে। বিড়ির ওপর ধার্য কর অত্যন্ত কম এবং তা কেবল সরকার নির্দিষ্ট ট্যারিফভ্যালুর ওপর প্রযোজ্য। তামাক পণ্যের এ জটিল কর কাঠামোর সুবিধা পাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো এবং সরকার এ খাত থেকে সম্ভাব্য রাজস্ব আয় করতে পারছে না।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে তামাকের ব্যবহার কমানোর সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে তামাকজাত পণ্যের ওপর এমনভাবে কর বাড়ানো যাতে এসব দ্রব্যের মূল্য নিশ্চিতভাবে বাড়ে। সিগারেটের অতিরিক্ত মূল্য তরুণদের ধূমপান করা থেকে বিরত রাখবে এবং বর্তমান ধূমপায়ীদের সিগারেট সেবন ছেড়ে দিতে ভূমিকা রাখবে। বলা হয়েছে বাংলাদেশে বিদ্যমান মূল্যস্তর ভিত্তিক কর কাঠামোর পরিবর্তে সব ধরনের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের ওপর ৩৪ টাকা হারে একক (স্পেসিফিক ট্যাক্স) আরোপ করা হলে সিগারেটের ওপর একসাইজ ট্যাক্সের (সম্পূরক শুল্কর) পরিমাণ হবে গড়পড়তা খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ। আর বিড়ির ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ শলাকার প্যাকেটের খুচরা মূল্যের ওপর ৪ দশমিক ৯৫ টাকা হারে কর আরোপ করা হলেও একসাইজ ট্যাক্সের পরিমাণ হবে গড়পড়তা খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ। এর ফলে প্রায় ৭০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী সিগারেট সেবন ছেড়ে দেবেন। ৭১ লাখ তরুণ ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত হবে। প্রায় ৬০ লাখ অকাল মৃত্যুর রোধ করা যাবে এবং সরকার ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করবে। এ ছাড়া বিড়ির ক্ষেত্রে প্রায় ৩৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ি ধূমপায়ী বিড়ি সেবন ছেড়ে দেবেন। প্রায় ৩৫ লাখ তরুণ নতুন করে বিড়ি সেবন শুরু করবে না। প্রায় ২৪ লাখ অকাল মৃত্যু রোধ করা যাবে এবং বিড়ি থেকে সরকার বাড়তি ৭২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে। সিগারেট এবং বিড়ি থেকে যে বাড়তি ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে তা দিয়ে ১২ হাজার ৩৩৩টি বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।
সিগারেটের কর বিষয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বসির উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কখনও কর ফাঁকি দেই না। এই এনবিআরএ দাঁড়িয়েই আমি জোর দিয়ে বলছি আকিজ গ্রুপ কর ফাঁকি দেয় না। তারপরও পত্রিকায় রিপোর্ট বের হয়েছে আকিজের কর ফাঁকি নিয়ে। আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে কর বিষয়ে আপনাদের চাওয়া কি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আপনাদের বলে লাভ কি। আমরা এনবিআরের চেয়ারম্যান মহোদয়কে বলেছি, আবারও বলব।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর ২০১১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সিগারেট সস্তা। এতে বলা হয়েছে শ্রীলঙ্কায় এক প্যাকেট সিগারেটের দাম যখন ৭ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার তখন বাংলাদেশে এক প্যাকেট সিগারেটেন দাম ১ দশমিক শূন্য ৬ মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতে ৩ দশমিক ৯৫ মার্কিন ডলার, থাইল্যান্ডে ৩ দশমিক ৩৮ ডলার, নেপালে ২ দশমিক ৬৫ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ১৪ ডলার, মালদ্বীপে ১ দশমিক ৮২ ডলার এবং মিয়ানমারে ১ দশমিক ৩৭ ডলার। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সিগারেটের দাম সবচেয়ে কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে তামাক জাতীয় পণ্যের ওপর অধিকহারে করারোপের পরিকল্পনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার এবার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পর্কে আমরা সবাই সচেতন, তাই কর বাড়াতে কোন সমস্যা নেই।
সূত্র জানায়, আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তামাক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তামাক ব্যবহার হ্রাসের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি। তামাক নিয়ন্ত্রণে তামাক পণ্যের ওপর করারোপের কার্যকারিতা এমনকি তামাক কোম্পানির দ্বারাও স্বীকৃত। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিচের এক নথিতেও পাওয়া যায় এর প্রমাণ। এতে বলা হয়েছে, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সবগুলো উদ্বোগের মধ্যে একটি আমাদের সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত করে তা হচ্ছে করারোপ। যদিও তামাকের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং জনসমক্ষে ও পরোক্ষ ধূমপানের ওপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবসা সংকুচিত করে, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে তামাক পণ্যে করারোপ আরও ব্যাপকভাবে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করে।
অন্তত তিনটি বিবেচনায় তামাক পণ্যের ওপর অধিকমাত্রায় কারারোপ করা জরুরী বলে মনে করছে তামাকবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর নেতারা। তা হচ্ছে প্রথমত, জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় তামাকের ব্যবহার কার্যকরভাবে কমানোর জন্য তামাকের প্রকৃত মূল্য বাড়ানোর জন্য। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বিবেচনায় তামাকের কর ও মূল্যবৃদ্ধি লাভজনক এবং তৃতীয়ত ফ্রেকওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) সদস্য দেশ হিসেবে আইনগত বাধ্যবাধকতা, কারণ এই আন্তর্জাতিক চুক্তিতে তামাকের মূল্য বাড়ানোর জন্য যথাযথ রাজস্ব নীতি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কার্যকর করের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে মনে করা হচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলোর অপতৎপরতা। এ কারণে তামাক পণ্যের কার্যকর কর ধার্য করা যাচ্ছে না। কেননা তারা বাজেটের আগে পরিকল্পিতভাবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তৎপরতা চালায়। এ প্রক্রিয়া গত অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরে তারা সফলও হতে পেরেছে বলে জানা গেছে। তামাক বিরোধী আন্দোলনকারীদের মতে এই গোষ্ঠীর অপকতৎপরতা রোধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুতই।
তামাকের কর সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তামাক পণ্যের ওপর ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কধার্য করা হলে এক বছরে বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৬০ কোটি শলাকা সিগারেট ও বিড়ির ব্যবহার কমবে এবং তামাক খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব অর্জিত হবে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়িত না হওয়া এবং প্রতিবছর সিগারেট ও বিড়ির প্রকৃত মূল্য কমছে। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যে হারে বাড়ছে তামাক পণ্যের দাম সে হারে বাড়ছে না। ফলে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তুলনায় তামাকজাত পণ্য সস্তা হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার কমছে না বরং বাড়ছে। ২০০৪ সালে তামাক পণ্যের ব্যবহার ছিল ৩৭ শতাংশ ২০০৯ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। আর বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাড়ছে উৎপাদন। সিগারেটের উৎপাদন ১৯৯৪ সালে ছিল ১ হাজার ৬শ’ শলাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬শ’ শলাকায়। অর্থাৎ ১৬ বছরে উৎপাদন প্রায় দিগুণ হয়েছে।
তামাক পণ্যের দাম বাড়লে যে এর ব্যবহার কমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এটি প্রমাণিত। ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাংলাদেশে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য যখনই বেড়েছে, তখনই এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজাত দ্রব্যের ১০ শতাংশ (প্রকৃত) মূল্যবৃদ্ধি করা হলে এর ব্যবহার উন্নত দেশে ৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৮ শতাংশ কমে আসে।
এ বিষয়ে ক্যাম্পেইন ফর ফ্রিকিডসের প্রধান তাইফুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর দামী সিগারেটের দাম কিছুটা বাড়ে। কিন্তু কম দামী সিগারেটের দাম খুব কম বাড়ছে। যেটুকুও বাড়ছে এতে লাভ হচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলোর।
Source: Daily Janakantha
হামিদ-উজ-জামান মামুন,মঙ্গলবার, ৬ মে ২০১৪