কর ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ তামাক কোম্পানির
হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দেশের কর ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছে তামাক কোম্পানিগুলো। এটি হচ্ছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব দিক থেকেই। ফলে বাজেটে কার্যকর করারোপ হয় না কোনবছরই। যেটুকুও কর আরোপ করা হয় তার খুব বেশি লাভ পায় না সরকার। দেখা যায় সব ধরনের তামাক পণ্যের খুচরা মূল্যের উপর একই হারে স্পেসিফিক ট্যাক্স (সম্পূরক শুল্ক) আরোপ না করে মূল্যস্তরভিত্তিক করারোপ করায় সুকৌশলে লাভবান হচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো।
তামাক কোম্পানিগুলোর এসব অপতৎপরতার বিষয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, তামাক কোম্পানিত চেষ্টা করবেই কর কমানোর জন্য। তারা যতই তৎপরতা চালাক না কে কোন লাভ হবে না। কেননা এবার বিষয়টি এমনভাবে ফোকাস হয়েছে যে, পিছনে সরে আসার কোন পথ নেই। আমি নিজেও বলেছি কর বাড়বে। তাছাড়া স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা ভেবে ব্যক্তিগতভাবে আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। অর্থমন্ত্রী এবং এনবিআরএর চেয়ারম্যানও বলেছেন, তামাক পণ্যের উপর কর বাড়বে। আমরা সবাই চাচ্ছি কর বারুক।
তামাক কোম্পানি হস্তক্ষেপের একটি উদাহরণ হচ্ছে, গত ২৮ এপ্রিল, সকাল ১০টা। রাজধানীর সেগুনবাগিচার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবন। হঠাৎ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান আসায় চেয়ারম্যানের ফ্লোরে সাংবাদিকদের ঢুকতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তাই বারান্দায় বসে মন্ত্রীদের চলে যাওয়ার অপেক্ষা। অন্যদিকে সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা একে একে ঢুকছেন ভেতরে। বরান্দায় দু-এক জনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মিডিয়ার পরিচয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে কেটে পড়ছেন তাঁরা।
এ অবস্থায় বেলা ১১টার দিকে মন্ত্রীরা এনবিআর থেকে বেরিয়ে যান। এনবিআরর চেয়ারম্যানের সম্মেলন কক্ষে পূর্বনির্ধারিত প্রাক-বাজেট আলোচনার জন্য সিগারেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা এবং সাংবাদিকরা ঢুকলেন। তার পর শুরু হলো এনবিআরর প্রধান বাজেট সমন্বয়কের সঙ্গে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদের তদবির। প্রকাশ্য আলোপনা হবে, নাকি গোপনে। শেষ পর্যন্ত সফল হলেন তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরাই। এনবিআরর চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষেই প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার রুদ্রদার বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কেউ মুখ খুললেন না। সাংবাদিকদের এক ধরনের ঠেলে দূরে সরিয়ে চলে যান কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এ সময় বাজেট প্রস্তাবনা নিয়ে এত লুকোচুরি খেলা কেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্ধ হন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বসির উদ্দিন।
উল্টো তিনি বলেন এসব কেমন প্রশ্ন? তার পর তারা সবাই মিলে চলে যান মূসক বাস্তবায়ন এবং আইটির সদস্য ফিরোজ শাহ আলমের কক্ষে। সেখানে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশ নেন ব্রিটিশ আমোরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের চেয়ারম্যান গোলাম মাইনুদ্দিন, একই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেহজাদ মুনেম, আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বসির উদ্দিনসহ অন্যরা। তার আগে ধারাবাহিক প্রাক-বাজেট আলোচনার শুরুতেই অন্যান্য কয়েকটি এ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনকে আলোচনার জন্য দাওয়াত দেয় এনবিআর। কিন্তু যেহেতু সেই আলোচনা হলে প্রকাশ্যেই হতো তাই এনবিআরে আসেননি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এভাবেই লুকোচুরির মধ্য দিয়ে মিডিয়া এবং সবার অন্তরালে কর ব্যবস্থায় প্রতিবছরই হস্তক্ষেপ করে তামাক কোম্পানিগুলো। যার ফলে বাজেটে কার্যকর করারোপ হয় না কোনবছরই।
তামাক বিরোধী আন্দোলনের সংগঠনের নেতাদের আশঙ্কা আগামী বাজেটের আগেও গোপন অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। ফলে অদৃশ্য কারণে বাজেটে কর কাক্সিক্ষত হারে না বাড়নো বা বিদ্যমান মূল্যস্তর বাতিল না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
লুকোচুরি বিষয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কথা হয় ব্রিটিশ আমোরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের চেয়ারম্যান গোলাম মাইনুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। তবে একপর্যায় তিনি বলেন, আমরা চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু আমাদের আবারও আলোচনার জন্য আসতে হবে। আজ বলার মতো কিছুই হয়নি।
সম্প্রতি প্রজ্ঞা প্রকাশিত জনস্বাস্থ্য সবার উপরে বাংলাদেশের তামাক মহামারি রুখতে তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন শীর্ষক এক গবেষণা বইতে বলা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করতে একই ধরনের কৌশল অব্যাহতভাবে ব্যবহার করে থাকে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও তামাক কোম্পানির থাবা থেকে মুক্ত নয়। দেশী-বিদেশী কোম্পানীগুলো তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-কে প্রভাবিত করে আসছে। আর এই প্রভাবিত করার উপায় হিসেবে তারা নানামুখী কৌশল অবলম্বন করে। যার মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ, বুদ্ধিজীবী ও সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের একত্রিকরণ, লবিং, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ, গবেষণায় অর্থায়ন ও বৈজ্ঞানিক পরামর্শক নিয়োগ, তথ্য বিকৃত করা, স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভ্রান্তিমূলক ফ্রন্ট গ্রুপ তৈরি ও ব্যবহার, এনজিও ও এ্যাডভোকেসিতে জড়িতদের অর্থায়ন, মামলা-মোকদ্দমা, হুমমি প্রদান, জনসেবা ও কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচী, জনসংযোগ, চোরাচালান এবং আইনের ধারা অমান্য বা ভঙ্গ করা ও আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো। বলা হয়েছে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মূলত : নীতি কেন্দ্রীক, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আইন সংশোধনী ও করনীতি প্রণয়নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিশেষ করে কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসেবিলিটির (সিএসআর) নামে তামাক কোম্পানিগুলো কর ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপসহ তাদের পণ্যের প্রচার ও তাদের পক্ষে নীতি নির্ধারকদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিএসআর খাতে ২০০৯ সালে ব্যাপক পরিচিত একটি সিগারেট কোম্পানি যেখানে ৬ কোটি ১২ হাজার টাকা খরচ করেছিল সেখানে ২০১০ সালে তা বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ১১ কোটি ১১ লাখ ১২ হাজার টাকা খরচ করেছে।
বাজার তথ্য খাতেও ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ওই খাতে এক বছরের ব্যবধানে খরচ ১২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। বাজার তথ্য খাতে খরচ করতে গিয়ে মূলত নিজেদের প্রমোশনাল কাজই করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওই কোম্পানিটি ২০১০ সালে সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে ব্যয় করেছে ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা, ব্রান্ড বাজারজাত বাবদ ব্যয় করে ৪৪ কোটি ৬৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ট্রেড বাজারজাত বাবদ ব্যয় করে ৬৯ কোটি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বাজার তথ্য খাতে গত ৫ বছরে ব্যয় করেছে ১৬ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৪২ কোটি ৬৯ লাখ ৮ হাজার টাকা ব্যয় করেছিল ব্রান্ড বাজারজাত খাতে। এ খাতে এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়েছিল কোম্পানিটি। যা বর্তমানে আরও বেশি হবে। কোম্পানিটির দীর্ঘ বছরের এক আর্থিক বিবরণী থেকে দেখা যায়, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের কাছাকাছি সময় থেকে প্রতিষ্ঠানটি সিএসআর এর নামে অর্থ ব্যয় করতে শুরু করে। ওই প্রতিষ্ঠানটি ২০০২ সালে প্রথম সিএসআর খাতে ব্যয় দেখায় ৩ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এর পর গত দশ বছরে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে প্রায় পাঁচগুণ।
কোম্পানির দায়িত্বশীলরা সিএসআর খাতের ব্যয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, বৃক্ষরোপণ, ব্যাটল অব মাইন্ড, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও ব্রেইনড্রেইনসহ বিভিন্নভাবে তারা সিএসআর খাতে অর্থ ব্যয় করে থাকে। এ কোম্পানটি ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করছে বলে জানায় তামাক বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্তরা। তাদের মতে সিএসআর এবং ব্রান্ডিংর নামে বাংলাদেশের তামাক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বছরে অন্তত ২শ’ কোটি টাকা ব্যয় করে। এই টাকা দিয়ে প্রতিবছর ৫০ শয্যা বিশিষ্ট প্রায় ২৫টি করে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রতি হাসপাতালে বহির্বিভাগসহ গড়ে প্রতিদিন ২শ’ মানুষকে সাধারণ রোগের চিকিৎসা দিলে সেগুলোতে বছরে চিকিৎসা নিতে পারত প্রায় দেড় কোটি মানুষ। তাদের মতে সিএসআর বিষয়টি হচ্ছে লোক দেখানো। সিএসআর হিসেবে এসব কার্যক্রম দেখানো হলেও এর পেছনে থাকে অন্য উদ্দেশ্য। সামান্য সিএসআর কাজ করে পত্রিকায় বড় বড় করে বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়। এসব বিজ্ঞাপনে তাদের কোম্পানির লোগো থাকে। যার মূলেই রয়েছে ব্রান্ড প্রমোশন বা কৌশলে প্রচার এবং করা ফাঁকি দেয়ার জন্য সহানুভূতি আদায়।
আগে থেকে তামাক পণ্যের দাম বাড়বে এ আওয়াজ দিয়ে গোপনে তামাক কোম্পানিগুলোর কাছে বেশি অর্থ নেয়ার অভিযোগ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এটি ঠিক নয়, আগামী বাজেটেই দেখবেন কি হয়। তামাক কোম্পানির সঙ্গে রুদ্রদার বৈঠক বিষয়ে তিনি বলেন, ওই বৈঠকে বাজেটে কর বাড়া না বাড়া নিয়ে আলোচনা হয়নি। তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে মামলা নিয়ে। তাই রুদ্রদার বৈঠক করে কর সুবিধা দেয়ার কোন বিষয় নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমি সব সময়ই তামাক কোম্পানির বিপক্ষে রয়েছি। আগামী বাজেটে তামাক পণ্যের উপর কার বাড়ানো উচিত। তবে কর বাড়বে বলেই ইতোমধ্যেই এনবিআরএর চেয়ারম্যান আমাকে বলেছে। তামাকের ব্যবহার কমাতে আমি তামাক চাষে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তামাক বিরোধী আন্দোলনের সংগঠনের নেতাদের মতে, তামাক কোম্পানিগুলো মৃত্যুর সওদাগর হওয়া সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে তারা একটি পজেটিভ ইমেজের সুবিধা উপভোগ করে থাকে এ ইমেজ তৈরির অন্যতম মাধ্যম তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর কার্যক্রম।
সামাজিক কর্মসূচীর নামে তামাক কোম্পানিগুলো যে নানাভাবে তাদের হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখে তার প্রমাণ মেলে তামাক কোম্পানির ভেতরকার বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত প্রতিবেদনে। যা ইতোমধ্যেই জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে। তাই তামাকের ব্যবহার রোধে তাদের প্রস্তাব হচ্ছে আগামী বাজেটে সব ধরনের তামাক পণ্যের খুচরা মূল্যের উপর ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, সিগারেটের উপর প্রচলিত জটিল মূল্যস্তর প্রথা তুলে দেয়া, সব ধরনের সিগারেটের উপর একই হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, বিড়ির উপর উচ্চহারে একক সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
সব ধরনের তামাক পণ্যের উপর সিগারেটের সমপরিমাণ কর আরোপ করা, সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে তামাকের মূল্যের বাৎসরিক সমন্বয় সাধর করা এবং তামাকের কর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা।
Click here for translated version
Source: Daily Janakantha,Hamid Uz Zaman Mamun,21may,2014