তামাক চাষীদের সর্বনাশ
বিড়ি-সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে তামাক চাষীরা সর্বনাশা পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। কোম্পানির আগাম টাকায় তামাক চাষ হলেও উৎপাদন শেষে চাষীদের হাতে কোনো টাকা থাকে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলে কোম্পানিগুলোও দাম কম দেয়। ফলে চাষীরা আর্থিক সংকটে পড়ে। এই সংকট মোকাবেলায় চাষীরা জমি বিক্রি করে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে। অন্যদিকে যে জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, সে জমিতে অন্য কোনো ফসল হচ্ছে না। ফলে চাষীদের তামাক ছাড়া অন্য কোনো ফসল চাষ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া তামাক চাষের ফলে চাষীরা স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব কারণে তামাক চাষ করে চাষীরা এখন নিস্ব হওয়ার উপক্রম হয়েছেন।
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন কম হওয়া ও তামাকের দাম কমে যাওয়ার কারণে চাষীরা একদিকে লাভের মুখ দেখছেন না, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামগঞ্জের জীবন-যাত্রার ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সমন্বয় না থাকায় চাষীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। শেষ পর্যন্ত চাষের জমিটুকু বিক্রি করে দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবেলা করছেন অনেকে। কক্সবাজারের তামাক চাষের জন্য খ্যাত অঞ্চল চকোরিয়ার কৃষকদের ওপর অনুসন্ধান করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে গত ৫ বছরে গড়ে প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে ৫ বছরে ১০০ টাকায় কমেছে ৫৪ টাকা। কিন্তু সেভাবে বাড়েনি তামাক চাষে মুনাফা। কৃষকের হিসাবে এটি লোকসানি চাষ। ফলে একদিকে লোকসান গুনছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির আঘাতে তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে ২০০৯ সালে চকোরিয়ার কাকারা অঞ্চলের একজন কৃষক ১৯৪ টাকা দিয়ে যে পণ্য ক্রয় করেছেন, ২০১৪ সালে ওই পণ্য কিনতে ১৯৭ টাকা গুনতে হচ্ছে। এতে কৃষক পরিবারগুলোর জীবন-যাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। উভয় আঘাতে একজন তামাক চাষী দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। বেচে থাকার তাগিদে হাতছাড়া করছেন চাষের জমিও।
বিষয়টি নিয়ে চকোরিয়ার তামাক চাষী, উৎপাদনকারী, অর্থনীতিবিদ ও সরকারের পলিসি পর্যায়ে অনুসন্ধান করা হয়। এতে চাষের জমি বিক্রি করে বেচে থাকার চাঞ্জল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলা প্রসঙ্গে কথা হয় চকোরিয়া কাকারা ৫ নম্বর ওয়ার্ড মাইসকাকেরা কৃষক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, পরিবারের ৮ সদস্য তামাক চাষের ওপর নির্ভরশীল। তার হিসাবে বছরে পারিবারিক খরচ ২ লাখ টাকা। কিন্তু সবকিছু মিলে তার আয় আসে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। বাকি অর্থ ঋণ করে চলতে হয়। এভাবে চলতে গিয়ে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তার মতে, গত ৫ বছরে সংসারের খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে তামাক চাষে আয় বাড়েনি। কষ্ট করে চাষ করেও দাম পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি গত বছর ২ কানি চাষের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
পড়ন্ত বিকালে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে কাকারার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক সুকুমার রায় এই প্রতিবেদকে বলেন, আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে ৬ কানি জমিতে তামাক চাষ করেছেন। কিন্তু বিক্রি করেছেন মাত্র দেড় লাখ টাকা। সুকুমার রায়ের মতে, বছরে তার সাংসারিক খরচ প্রায় ৩ লাখ টাকা, যা পাতা চাষ করে এই ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। এই চাষের একদিকে লোকসান ও অন্যদিকে জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে গত বছর তিনি এককানি জমি বিক্রি করেছে বলে জানান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তামাক চাষে লোকশানের পেছনে রয়েছে কোম্পানিগুলোর নানা কৌশল। শেয়ার বাজারের মতো আকস্মিক দাম বাড়ান, হঠাৎ পাতা ক্রয় বন্ধ, চাঁদাবাজদের বাধ্যতামূলক কমিশন আদায়সহ নানা কৌশলের শিকার হচ্ছেন কৃষকরা। এতে চাষীরা পাতা চাষে লাভ দেখছেন না। এই কৌশলের কথা তুলে ধরেন একই এলাকার কৃষক মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, এ বছর এক কেজি তামাক পাতার মূল্য ১২০ টাকার উপর উঠেনি। খেত থেকে তোলার শুরুতে পাতার প্রথম গ্রেডের মূল্য নির্ধারণ করে ১৪৫ টাকা। এরমধ্যে ৩ টাকা স্থানীয় চাঁদাবাজদের কমিশন কেটে রাখা হয় বিক্রয় কেন্দ্রে। ফলে একজন কৃষক প্রকৃত মূল্য পায় ১৪২ টাকা। তার মতে, প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় থেকে টানা দেড় মাস কোম্পানিগুলো কৃষকদের কাছ থেকে পাতা কিনে। কিন্তু এ বছর মাত্র ২০ দিনের মাথায় পাতা কেনা বন্ধ করে দেয়। এতে মহাবিপাকে পড়েন চাষীরা। একদিকে পাতা কেনা বন্ধ ঘোষণা দিলেও অন্য দিকে আবার কম দামে অর্থাৎ ১৪৩ টাকা দরের তামাক কৃষকদের বেকায়দায় ফেলে ১শ থেকে ১০৫ টাকা দরে কিনে নিয়েছে। এই কৌশলের কারণে চাষীদের এ বছর ব্যাপক লোকসান হয়েছে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সুবিধা দেয়ার নামে কৃষি উপকরণ উচ্চ মূল্যে তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের হাতে গছিয়ে দিচ্ছে। একবস্তা সার খোলা বাজারে ৩ হাজার টাকা কিন্তু কোম্পানি রাখছে ৩৫শ টাকা। এককেজি পলিথিনের মূল্য ১২০ টাকা হলেও নেয়া হচ্ছে ২শ টাকা। একজন চাষীকে এককানি জমিতে চাষের জন্য কোম্পানিগুলো ঋণ হিসেবে নগদ ২০ হাজার টাকা, সার বীজ বাবদ ২০ হাজার টাকা, মোট ৪০ হাজার টাকা দিচ্ছে। আবার এই অর্থ সমমূল্যের পাতা বুঝে নেয়ার পর শুরু করে কৃষক নির্যাতন। নির্যাতনের ধরন হচ্ছে বেশি মূল্যের পাতা কম দাম দিয়ে কিনে নেয়া হয়। এতে তামাক চাষ করলেও খরচ উঠছে না। এই কৃষকের দেয়া তথ্যমতে, কাকারা ইউনিয়নের প্রত্যেক চাষীর সর্বোচ্চ ৪ লাখ থেকে সর্বনিু ১ লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত।
ওই এলাকার কৃষক নুরু মিয়া তামাক খেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, তিনি তামাক চাষে লোকসানে পড়ে গত বছর আধাকানি জমি পৌনে ২ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। ওই টাকা দিয়ে তার ঋণ পরিশোধ করেন। তিনি বলেন, পরিবারে ৭ জন মিলে গত ৮ মাস জমিতে সময় দিয়েছেন। যার পারিশ্রমিক ধরলে এককেজি তামাকের উৎপাদন খরচ হবে ২শ টাকা। তিনি এককানি জমিতে সাড়ে ৫শ কেজি তামাক উৎপাদন করেছেন। এরমধ্যে বিভিন্ন কারণে বাদ পড়েছে ১শ কেজি। বাকি সাড়ে ৪শ কেজি ১৪২ টাকা দরে নেয়ার কথা। কিন্তু দাম দেয়া হয়েছে ১২০ টাকা। ওই হিসাবে তার এ বছর লোকশান হয়েছে কেজিতে ৮০ টাকা। এই লোকশানের পর কোম্পানির কাছ থেকে নেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে বাধ্য হয়েছেন জমি বিক্রি করতে। তিনি আরও বলেন, জীবন-যাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। বছরে আয় হচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু পরিবারের সাত সদস্যের পারিশ্রমিক ও ধানের খরচ মিলে ব্যয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নব্বই হাজার টাকার ঘাটতি থাকছে। এভাবে চলতে গিয়ে আমার আগামীতে আরও চাষের জমি হাতছাড়া হতে পারে এমন আশঙ্কাও করেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চকোরিয়ার কাকারায় এক সময় সব ধরনের শস্য উৎপাদন হতো। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলবনে পড়ে এখানের প্রায় ৪শ কৃষক ফসল বাদ দিয়ে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিযোগিতামূলক চাষ করতে গিয়ে ধানের জমি লিজ মূল্য গত কয়েক বছরে কয়েশগুণ বেড়েছে। আর ইচ্ছা থাকলেও এখানের কৃষকরা অন্য ফসল উৎপাদনে যেতে পারছেন না। কারণ এক জমির মূল্য অনেক বেশি, দ্বিতীয় অন্য ফসলের বাজারজাত সমস্যা। যে কারণে সব হারিয়ে এখন মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে ধান ও সবজি উৎপাদন হচ্ছে।
এ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তিন নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক আবদুর রহিম বলেন, নিজেদের মধ্যে চাষ নিয়ে এক সময় প্রতিযোগিতা হয়েছে। ফলে যে জমির কানি ১৮শ টাকা দিয়ে লিজ নেয়া যেত এখন এর মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার টাকা। এত বেশি মূল্য দিয়ে ধান ও তামাক উভয় চাষে লোকশান হচ্ছে।
এদিকে ফসল উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন জেলায় সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও চকোরিয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-২০১৬ এই তিন অর্থবছরের জন্য ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩টি জেলায় দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে। ইতোপূর্বে আরও অনেক প্রকল্প নেয়া হলেও এই অঞ্চলের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। যে কারণে কৃষকরা এই অঞ্চলে তামাক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।কৃষক মিয়া হোসেনের মতে, আমি একা ধান চাষ করতে চাইলে পারব না। অন্য কোনো চাষে যেতে পারব না। কারণ বিক্রির ব্যবস্থা নেই। এই কৃষক আক্ষেপ করে বলেন, বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করেও লোকশানি তামাক চাষ করছি। তার মতে, এখানে এক সময় ধান ও সবজি চাষ হয়েছে। কিন্তু এখন মাত্র ১০ শতাংশও শস্য চাষ হচ্ছে না। পুরোটা চলে গেছে তামাকের দখলে। ফলে এককানি জমিতে সবজি বা ধান চাষ করতে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে তার অনেক কম। কারণ বিক্রির সঠিক ব্যবস্থা নেই। ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। তামাক চাষের বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলের আন্দোলনকারী প্রবীণ কৃষক মোহাম্মদ আলীর মতে, চকোরিয়া প্রায় ৩ লাখ লোকের বাস। কিন্তু এখানে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। পণ্যের বাজারজাত ব্যবস্থা ভালো নয়। ফলে এখানে খাদ্যশস্যের চাষ কমেছে। বাজার থেকে অধিকাংশ কৃষকের নিত্যপণ্য কিনে খেতে হয়। এ জন্য আশপাশ অন্যান্য অঞ্চল থেকে এখানে নিত্যপণ্য আসছে।
Source: Jugantor,মিজান চৌধুরী,প্রকাশ : ০৩ আগস্ট, ২০১৪