তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা- লাল ফিতার বাঁধন খুলছে না
‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন-২০১৩’ পাস হয় গত বছরের ২৯শে এপ্রিল। এরপর এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন দেখা দেয় বিধিমালার। তারও খসড়া প্রণয়ন করে সরকার। কাজ শেষ হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। প্রস্তুতি ছিল নভেম্বরের মধ্যে সেটি চূড়ান্ত করার। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেটা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে সেখানেই। একটি ধারায় আপত্তি থাকায় ফাইলটি এখন পর্যন্ত আইন সচিবের টেবিলে আটকে আছে। বিধিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও তামাকবিরোধী সংগঠনের কর্মীরা আইন মন্ত্রণালয়ের ‘গড়িমসি’র কারণে সহসা বিধিমালা আলোর মুখ হয়তো দেখবে না- এমন সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, বিধিমালা জারি যত দেরি হবে, আইন প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নে ততটা বিলম্ব হবে। আর এটিই চাইছে তামাক কোম্পানিগুলো। এ কারণে নীতিমালা হলেও বিধিমালার অভাবে এখন পর্যন্ত অকার্যকর থেকে গেছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিধিমালার খসড়া প্রণয়নকারী কমিটির সদস্য সচিব এবং ন্যাশনাল টোব্যাকো কন্ট্রোল সেলের সমন্বয়কারী আমিন-উল-আহসান বলেন, বিধিমালা বিষয়ে আমরা এখন আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়কে একটি তাগাদাপত্রও দেয়া হয়েছে। বিধিমালাটি দ্রুত চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের ওপরই এখন নির্ভর করতে হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ একটি ধারা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের জোর আপত্তি। এটি হচ্ছে বিধিমালা কার্যকরের ৯ মাস পর নাকি ১৮ মাস পর তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণী যুক্ত করা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৯ মাসের প্রস্তাব করলেও আইন মন্ত্রণালয় ১৮ মাসের কথা বলেছে। চলতি বছরের ১২ই মার্চ গণমাধ্যমকে না জানিয়ে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আইন সচিব বৈঠক করেন। এরপরই এ ধারা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ১৮ মাসের প্রস্তাব দেন। আইন মন্ত্রণালয় সেটিকে আমলে নিয়ে বিধিমালায় তা সংযুক্তির সুপারিশ করে। গত জুলাইয়ে ওই সুপারিশের সঙ্গে আরও কিছু প্রস্তাবনা যোগ করে আইন মন্ত্রণালয় এটি ফেরত পাঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাতে সম্মত হয়নি। তারা আগের ধারা রেখেই একই মাসের শেষ দিকে আবার সেটি পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়ে। এখনও সেটি রয়েছে সচিবের টেবিলে। অ্যান্টি টোব্যাকো আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, কঠোর বিধি ছাড়া আইনের প্রয়োগ সম্ভব না-ও হতে পারে। আর বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা বলছেন, আইনটিকে যাতে সর্বত্র এবং সব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা যায় সে জন্য নানা দিক বিবেচনা করে খসড়া প্রণয়ন হচ্ছে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনায় কিছুু ধারা দুর্বল এমনকি তামাক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে আইন পাসের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি প্রস্তাবিত বিধিমালা। যদিও গত বছরের মাঝামাঝির দিকে একটি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া জানিয়েছিলেন, নভেম্বরে (২০১৪) বিধিমালাটি প্রকাশ করা হবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য তাইফুর রহমান বলেন, আমরা বিধিমালাটি যথেষ্ট শক্ত ও অ্যান্টি টোব্যাকোতে দারুণভাবে ভূমিকা রাখতে পারে- এমনভাবে খসড়া প্রণয়নের চেষ্টা করেছি। এতে ভুক্তভোগীর স্বার্থ রক্ষা রয়েছে। তবে এখন দেখার বিষয়, চূড়ান্ত বিধিমালায় সেটি কেমন থাকে।
প্রণয়ন কমিটি সূত্র জানিয়েছে, বিধিমালা আইন বাস্তবায়নের সব ক্ষেত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চিহ্নিত করে তাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। খসড়া বিধিমালায় ১৮ বছর বয়সের নিচে কারও কাছে বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য বিক্রি না করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া তামাকজাত সব পণ্যের মোড়কের অন্তত অর্ধেক জায়গাজুড়ে ভিক্টোরিয়াল ছবিসহ সতর্কবাণী সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। কোথাও ফুসফুসে কালো দাগ পড়ার ছবি, আবার কোথাও থাকবে মুখ বা চোয়ালের ক্ষতের ছবি। তার সঙ্গে তো সতর্কবাণী থাকবেই। ছবি সংযোজনের জন্য কোম্পানিগুলোকে প্রথমে ৬ মাসের সময় দেয়া হয়। পরে তা ৯ মাস করা হয়। এর মধ্যে তারা তা না করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার। বিধিমালায় তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তামাক ব্যবসায়ীরা আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে জনহিতকর কাজ করে জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের আনুকূল্য পেতে নানা পদক্ষেপ চালাতে দেখা যায়। ‘প্রবাহ’, ‘দীপ্ত’, গণমাধ্যম বা বড় ইভেন্টের স্পন্সর ইত্যাদি উপায়ে তারা কৌশলে বিজ্ঞাপন অথবা নিজেদের প্রসারের প্রচেষ্টা করে। এসব ফাঁকফোকর এবং আইনের কিছু স্পর্শকাতর বিষয়েও সমাধান দেয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তামাক কোম্পানি তাদের নাম, লোগো ও রঙ ব্যবহার করতে পারবে না।
বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা জানান, এটি কার্যকর হলে পাবলিক প্লেস বা পরিবহনে ধূমপান করলে মালিককে জরিমানা করা যাবে। আইনে বলা আছে, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, প্রত্যেক পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা ব্যবস্থাপক বিধি দ্বারা নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ এ সব স্থানে কেউ ধূমপান করলে সংশ্লিষ্ট স্থান বা পরিবহনের মালিক শাস্তি বা জরিমানার আওতায় আসবেন। বিধিটি পাস না হওয়ার কারণে তা এখনও প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর তামাক ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের ১২ লাখ লোক ৮টি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর এ সব রোগীর মাত্র ২৫ শতাংশ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১১,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে প্রতি বছর বাংলাদেশে ৫৭,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। পঙ্গুত্ববরণ করছে ৩ লাখ ৮২,০০০ লোক। ২০০৯ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী ৪ কোটি ১৩ লাখ লোক তামাক সেবন করে, যা মোট জনসংখ্যার ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আর পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৫৮ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে এ হার ২৮ দশমিক ৭।
Source:মানবজমিন, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪