লামায় তামাক শুকাতে পোড়ানো হয় সংরক্ষিত বনের ৫০ হাজার মেট্রিক-টন কাঠ
চট্টগ্রাম সংবাদদাতাপার্বত্য বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও নাইংছড়ি উপজেলা এবং লামার পার্শ্ববর্তী কক্সবাজারের চকরিয়ার রামু বিলছড়ি এলাকার ৩ হাজার তামাক চুল্লিতে (তামাক শুকানোর তন্দুলে) চলতি মৌসুমে তামাক শুকাতে গিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন কাঠ জ্বালানো হয়েছে। তামাক প্রক্রিয়া-জাত করণের কাজে এ বিপুল পরিমান জ্বালানী কাঠ (লাকড়ী) জ্বালিয়ে নিঃশেষ করা হলেও বন সংরনে স্থানীয় বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন একেবারে নিরব। লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাঈদ আলী বলেন, সরকারী ভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমিতে তামাক চাষের বিরুদ্ধে কোনো প্রদপে নেওয়া যাচ্ছেনা। বন কর্মকর্তা আরও জানান, দু‘বছর পূর্বে ২০১১ সালে তামাক চাষের উপর আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর তামাক কোম্পানী গুলো বান্দরবান জজ কোর্টে রিট করার পর স্বল্প আকারে ১০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষের জন্য অনুমতি দেয় আদালত। আর এই সুযোগে লামা আলীকদম ও নাইংছড়ি এবং চকরিয়ার বমুবিলাছড়ি এলাকায় ফসলি জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। ধ্বংস করা হচ্ছে বনের মূল্যবান কাঠ। বিরান ভূমিতে পরিনত হয়েছে লামা-আলীকদম ও নাইংছড়ির হাজার-হাজার একর পাহাড়। জানাগেছে, লামা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৯৮৩ সালে অল্প পরিমান জমিতে তামাক চাষ শুরু হয়। এর পরের বছরই (অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে) ছড়িয়ে পড়ে লামা উৃপজেলার ৭টি ইউনিয়ন লামার পাশ্ববর্তি আলীকদম, নাইংছড়ি উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকায়, দীর্ঘ আড়াই যুগ ধরে স্থানীয় সংরতি এবং অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলের মূল্যবান বৃ নিধন এবং কৃষকের বাড়ির আঙিনার মূল্যবান বনজ এবং ফলদ গাছ নিধন করে পোড়ানোর কারণে বর্তমানে পাহাড় গুলো বৃশূণ্য মুরুভূমির দ্বার প্রান্তের। তামাক কোম্পানী গুলোর স্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, চলতি মৌসুমে লামা, আলীকদম নাইংছড়ি এবং পার্শ্ববর্তী রামু বিলাছড়ি এলাকার প্রায় ১৫ হাজার একর ফসলী জমিতে তিকর তামাক চাষ করা হয়েছে। এই সকল তামাক প্রক্রিয়া জাত করণের কাজে নিমাণ করা হয় প্রায় ৩ হাজার তামাক চুলি। তামাক কোম্পানী গুলো তামাক চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চাষীদেরকে বীজ, সার, কীটনাশক, পাওয়ার পাম্প ও প্রয়োজনীয় অর্থ সহ সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করলেও তামাক প্রক্রিয়াজাত করণের জন্য তামাক চুলির জ্বালানী সরবরাহ করে না। ফলে চাষীদেরকে তামাক চুলির জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে লামা, আলীকদম, নাইংছড়ি এবং পার্শ্ববর্তী বমু বিলছড়ি এলাকার সরকারের সংরতি এবং অশ্রেনীভূক্ত বনাঞ্চলের বনজ সম্পদ ধংসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। লামার স্থানীয় চাষীদের সাথে কথা বলে জানাযায়, প্রতিটি তামাক চুলিতে প্রায় ৪শ’ মন লাকড়ীর প্রয়োজন পড়ে, সে হিসাবে লামা, আলীকদম, নাইংছড়ি এবং রামু বিলছড়ি এলাকার ২ হাজার তামাক চুলিতে চলতি মৌসুমে প্রায় ৮ ল মন জ্বালানী কাঠ পোড়ানো হয়েছে। প্রতিমন জ্বালানী কাঠ ৮০ টাকা মন হিসাবে যার স্থানীয় বাজার মুল্য ৬ কোটি ৪০ ল টাকা। অপরদিকে, প্রতিটি তামাক চুলি নির্মানে ৩০ টি বড় মাপের খুটির প্রয়োজন হয়।
সেই হিসাবে ২ হাজার তামাক চুলিতে ৬০ হাজার খুটির প্রয়োজন। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি খুটির সর্বনিন্ম ৫০ টাকা মুল্য হিসাবে মোট মূল্য দাড়ায় ৩০ ল টাকা। এছাড়া চুলি নির্মানে বিপুল পরিমান বাঁশেরও প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে চলতি মৌসুমে লামা, আলীকদম এবং পার্শ্ববর্তী বমু বিলছড়ি এলাকার তামাক প্রক্রিয়া জাত করনের কাজে প্রায় ৭ কোটি টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংসের আশংকা করা হচ্ছে। তামাক প্রক্রিয়াজাত করণের কাজে স্থানীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করার পাশাপশি কৃষকের বাড়ির আঙিনার মূল্যবান বনজ গাছের পাশাপশি আম ও কাঁঠাল গাছ গুলোও তামাক চুল্লির খোরাক হয়ে আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে।
স্থানীয় চাষিরা জানান, তামাক চাষের আগে এসব জমিতে ধানের পাশাপাশি বিভিন্ন তরিতরকারি চাষ করা হতো। আর এসব তরকারি অত্র অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে পাশ্ববর্তি চকরিয়া ও চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হতো। তামাক চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে এসব জমিতে ধান বা অন্য কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। তামাক কোম্পানী গুলো প্রতি সৌসুমের শুরুতেই বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে চাষিদের এক লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে আট-দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত একেক চাষিকে অগ্রিম ঋণ প্রদান করে। আর এই ঋনের টাকা গ্রহন করে তামাক কোম্পানী গুলোর ঋনের জ্বালে আটকা পড়ে চাষিরা। বাধ্য হয়ে ফসলি জমিতে তামাক চাষ করে ঋনের টাকার বিনিময়ে তামাক দিয়ে পরিশোধ করতে হয় তাদের। চাষিরা আরও জানান, এক বছরে ঋনের বিনিময়ে তামাক দিতে না পরলে পরের বছর তামাক চাষ করে তামাক দিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয় তাদের। বর্তমানে লামা, আলীকদম ও নাইংছড়ি এবং চকরিয়া বমুবিলছড়ি এলাকায় আটটি তামাক কোম্পানী ব্যবসা করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানী, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবকো, ঢাকা ট্যোবাকো ও নিউ এজ ট্যোবাকো কোম্পানীসহ আরও কয়েকটি কোম্পনী রয়েছে।
Source:Dainikbangla,২৫ অক্টোবর ২০১৪