লালমনিরহাটে ঋণে সার কিনলেই সিগারেট কেনা বাধ্যতামূলক
লালমনিরহাট: লালমনিরহাটে সিগারেটের বিজ্ঞাপনে অভিনব কৌশল প্রয়োগ করেছে ঢাকা ট্যোবাকো কোম্পানি। ঋণের মাধ্যমে সার কিনলেই ৩শ’ টাকার সিগারেট কেনা বাধ্যতামূলক।
সরেজমিন এমনটাই দেখা গেল ঢাকা ট্যোবাকো কোম্পানির লালমনিরহাটের আদিতমারীর ট্যাপাহাট তামাক ক্রয় কেন্দ্রে।
কৃষকরা জানান, তামাক চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে কোম্পানিগুলো প্রতি বছর ফ্রি বীজ, ঋণ হিসেবে সার ও কীটনাশক দিয়ে আসছে। এবারে চিত্রটা একটু আলাদা। প্রতি দুই একর জমির ঋণের সার নিতে হলে সঙ্গে বাধ্যতামূলক কিনতে হচ্ছে ৩শ’ টাকার ২০ প্যাকেট ব্রিটন সিগারেট।
ইচ্ছে না থাকলেও অনেকটাই বিপাকে পড়ে সিগারেটগুলো কিনছেন তামাক চাষিরা। কোম্পানির মতে, তামাক চাষ করবেন অথচ সিগারেট কিনবেন না তা হয় না। আপনাদের উৎপাদিত তামাকের সিগারেট কেমন তা খেয়ে দেখেন। টাকা এখন লাগবে না তামাক বিক্রির সময় সারের সঙ্গে সিগারেটের টাকাও কেটে নিবে কোম্পানি।
এ ক্ষেত্রে বেশি বিপাকে পড়েছেন অধূমপায়ী কৃষকরা। তারা ৩শ’ টাকার সিগারেট কিনে মাত্র ৫০/৬০ টাকায় বিক্রি করছেন স্থানীয় সিগারেটের দোকানে।
তামাক চাষিরা জানান, প্রতি দুই বিঘা জমির জন্য ১শ’ কেজি ডিএপি, এসওপি ৫০ কেজি এবং ইউরিয়া ৫০ কেজি। বাজার মূল্যের চেয়ে সুদ হিসেবে বস্তা প্রতি নেওয়া হচ্ছে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা।
সরকার তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার কথা বললেও বাস্তবে সরকারের ভর্তুকির ইউরিয়া সার তামাক চাষিদের অনেকটাই উৎসাহিত করছে। এজন্যই অন্যসব পণ্য কেনার সময় রশিদ দিলেও ইউরিয়া সার বিক্রিতে চাষিদের কোনো রশিদ দেন না ট্যোবাকো কোম্পানি।
ঢাকা টোব্যাকো কার্যালয়ে সার নিতে আসা কৃষকদের সঙ্গে কথা হলে এমন তথ্যই বেড়িয়ে আসে।
তালুক হরিদাসের চাষি মতিয়ার রহমান, কান্তেশ্বরপাড়ার তামাক চাষি খালেক, ভাদাইয়ের চাষি হিতেন্দ্র নাথসহ অনেক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, মরার উপর খরার ঘাঁ। আমরা অভাবে পরে ঋণ হিসেবে সার নিতে এসেছি কোম্পানির কাছে। সেখানে আবার জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ৩শ’ টাকার সিগারেট। যা আমরা ব্যবহার করি না।
প্রকাশ্যে এমনিভাবে কৃষককে জিম্মী করে সিগারেট বিক্রি করছে ব্রিটিশ ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি।
কোম্পানির একটি সূত্র জানায়, ব্রিটিশ ঢাকা ট্যোবাকো ব্রিটন নামে নতুন ব্রান্ডের একটি সিগারেট বাজারজাত করতেই এমন কৌশল ব্যবহার করছে।
তামাক চাষিদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা ট্যোবাকোর একটি ক্রয় কেন্দ্রে অফিসার রয়েছেন ১৩ জন, ফিল্ড সুপারভাইজার রয়েছেন ৩৪ জন। এমনিভাবে তাদের নিজস্ব দু’টি তামাক ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে এ জেলায়।
কৃষি বিভাগের উদাসীনতা আর তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় আশ্বাসের ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে তামাক চাষের ব্যাপকতা। ফলে সবজি চাষের জেলা লালমনিরহাটে খাদ্যশস্য ঘাটতির পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বছর লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় ১১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। তবে কৃষি বিভাগের তথ্য মানতে নারাজ স্থানীয় চাষিরা। তাদের দাবি গত বছর ৩৫/৪০ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
তবে ঢাকা ট্যোবাকোর ক্রয় কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গত বছর লালমনিরহাটে ৭/৮ হাজার চাষির কাছ থেকে এক কোটি ৬৩ লাখ কেজি তামাক ক্রয় করেছে এ কোম্পানি। এ বছরও অনুরূপ পরিমাণের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে কোম্পানি।
শুধু ঢাকা ট্যোবাকোই নয় এ জেলায় রয়েছে আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো ও বিডিসি ট্যোবাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি। তারা ব্রিটিশ আমলের নীলকর জমিদারদের মতই বিষের আবাদ তামাক চাষের জন্য আস্তানা গেড়েছেন সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটে।
তামাক চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে ও বীজতলা এবং চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন লালমনিরহাটের চাষিরা। এসব কাজে পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুরাও অংশ নিচ্ছে।
ঢাকা ট্যোবাকোর ট্যাপারহাট ক্রয় কেন্দ্রের ম্যানেজার বেলাল হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায় নি।
তবে অফিসে উপস্থিত সিনিয়র লিফ অফিসার কৃষিবিদ মোস্তফা রাব্বী সিগারেট বিক্রির সত্যতা নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে বলেন, কোম্পানি নতুন ব্রান্ডের একটি সিগারেট বের করেছে তা বাজারজাত করতেই কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগ সিগারেট বিক্রি করছে।
সংশ্লিষ্ট আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা ট্রাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ভর্তুকির সার তামাক চাষে ব্যবহার করা এবং জোরপূর্বক কৃষককে সিগারেট দেওয়া দুটোই অপরাধ। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন বলেও তিনি জানান।
Source: banglanews24,নভেম্বর ২৬, ২০১৪