তামাকপণ্যের প্যাকেটে ছবিযুক্ত বার্তা প্রকাশের সময় বাড়ল
তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবার্তা প্রদর্শন করার সময় দুই মাস বাড়িয়ে এক বছর করা হয়েছে। এছাড়াও সিগারেটের প্যাকেটে সাত ধরনের ছবিসহ সতর্কবার্তা প্রদর্শনের কথা থাকলেও, এখন মাত্র একটি সতর্কবার্তা প্রকাশের বিধান রাখা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যে জানা গেছে, এ ব্যাপারে খসড়া বিধিমালাটি চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। জানা যায়, প্রায় দুই বছর আগে খসড়া প্রণয়ন করা হলেও, তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রদর্শনসহ সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় তামাকজাত পণ্যে সতর্কবার্তা প্রকাশের সময় বাড়ানো হলো যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠোর আইনের মাধ্যমেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ পণ্যটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণে যেসব সংশোধনী এসেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও জনগুরুত্ব সম্পূর্ণ। তবে অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে পূর্ণাঙ্গভাবে আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানের মতো দেশে সচিত্র সতর্কবাণী প্রদর্শনসহ নতুন আইন করা হয়েছে। যা চলতি বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, এখন সিগারেটের প্যাকের ৪০ শতাংশে ধূমপানবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। কিন্তু মার্চ থেকে প্যাকেটের উভয় পাশের ৮৫ শতাংশে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রদর্শন করতে হবে।
উল্লেখ্য, ভারত-নেপালের পর পাকিস্তান বিশ্বে তৃতীয় দেশ হিসেবে তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ছবিসহ সর্তকবার্তা প্রদর্শন ৮৫ শতাংশ বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তামাকবিরোধী ক্যাম্পেইন ‘ট্যোবাকো ফ্রি কিডস’-এর বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটর তাইফুর রহমান বলেন, যদি পাকিস্তান পারে, তবে আমরা পারব না কেন? সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন তাইফুর। তিনি জানান, তামাক কোম্পানিগুলোকে সিগারেটের প্যাকেটের উভয়পাশে ৫০ শতাংশজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ছাপানোর বিধান রেখে প্রায় দুই বছর আগে ২০১৩ সালের এপ্রিলে একটি খসড়া আইন পাস হয়।
প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রদর্শন করে প্রচারণা চালালে তা তামাক সেবনকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম। আর তা তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
গবেষকরা জানান, বছরে গড়ে সাত হাজার বার সিগারেটের প্যাকের গায়ে এসব সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা একজন ধূমপায়ীর চোখে পড়ে। শুধু তাই নয়, এসব স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা দেখার কারণে ধূমপানে অনুৎসাহিত হন তারা। এর ফলে অনেকেই ধূমপানের অভ্যাসও ত্যাগ করে থাকেন।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ৪৫ শতাংশ মানুষ ধূমপানে আসক্ত। ধূমপানবিরোধী আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখানকার মানুষের বাস্তব জীবনেও এসব আইনের চর্চা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কয়েক মাস সময় নিয়ে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। এরপরও আলোর মুখ দেখেনি সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন। আইন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে- এমন সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা। যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ধূমপানবিরোধী স্মারকে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এ বৈঠক করতে পারেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ওই সভায় সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন।
তবে গত বছরের আগস্টে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি যে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। এ সময় তিনি বলেন, আমি আইন অনুযায়ী কাজ করছি।
এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তাদের পক্ষে কথা বলতে বেশ কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে তামাক কোম্পানিগুলো। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা তৈরি করতে বিদেশ থেকে মেশিন আমদানিসহ বিভিন্ন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কথা তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানগুলো। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে, তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ১০ মাসের সময় নেয়। এই সময়ের মধ্যে সচিত্র সতর্কবার্তার বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে কোম্পানিগুলো। তবে প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখছে না তামাকবিরোধী সংশোধিত আইন। কবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে তা নিয়ে রয়েছে এখন ধোঁয়াশা। এ বিষয়ে ক্যাম্পেইন ফর ট্যোবাকো ফ্রি কিডস-এর কো-অর্ডিনেটর তাইফুর বলেন, আমরা খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে পাকিস্তান দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে দ্রুত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা সংযোজিত করা যায়। হতাশার বিষয় এটাই যে, এখনো আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি।
তাইফুর বলেন, প্রাথমিকভাবে বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য আমরা ছয় মাস সময় নিয়েছিলাম। কিন্তু পরামর্শক (প্যাকেজিং) কোম্পানির সঙ্গে বৈঠকের পর তা পরিবর্তন করা হয়েছে। তাদের (কোম্পানি) কাছে প্রিন্টিং মেশিন নেই- এমন একটি অস্পষ্ট অজুহাত দেখিয়েছে তারা। যদিও অন্যান্য প্রিন্টিংয়ের মতোই এটা একটা প্রিন্টিং প্রক্রিয়া। কিন্তু যখনই কোনো দেশে সচিত্র সতর্কবার্তার বিষয়টি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়, তখনই এই অজুহাতই দেখায় তামাক কোম্পানিগুলো। অবশ্য শেষে মেনে নিতেও বাধ্য হয়, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ তামাক সেবন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ তামাক সেবন ও এর কারণে সৃষ্ট রোগে মারা যায়। এছাড়া এ কারণে প্রায় ৩ লাখ লোক তাদের কর্মক্ষমতা হারায়। তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্মারকে স্বাক্ষর করার কারণে বাংলাদেশ ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
Source:Bhorerkagoj.Net, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫