পাহাড়ে তামাক কোম্পানি গুলো শিশু শ্রমকে উৎসাহ দিচ্ছে
বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় সমানতালে চলছে বন ধ্বংস ও তামাক চাষ। শুধু জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্যই নয়, তামাক চাষের জন্যও একরের পর একর জমি থেকে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে সবুজ। সেই সাথে ক্ষতিকর তামাক চাষে কাজ করছে স্থানীয় শিশুরা। বিষাক্ত নিকোটিনসমৃদ্ধ তামাক ক্ষেতে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছাত্ররা স্কুলে না গিয়ে সামান্য কিছু মজুরির বিনিময়ে স্থানীয় ভূস্বামীদের লোভের শিকার হচ্ছে। তামাকের ক্ষতিকর দিক জানার পরও তাদের এ কাজে ব্যবহার করছে তারা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র এবং সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের উন্নয়নে জেলায় কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও শিশুশ্রম বন্ধে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই পরিবারের অভাব দূর করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব শিশু বিদ্যালয়ে না গিয়ে ক্ষতিকর তামাক ক্ষেতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন, শিশু শ্রম বৃদ্ধি ও বন উজাড়ের এক তৃতীয়াংশের জন্যই দায়ী তামাক চাষ। কারণ তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে দিন দিন উক্ত চাষ বেড়েই চলছে। তামাক ক্ষেতে অল্পদামে কাজ সারতে চাষিরা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করছে শিশুদেরকে। অন্যদিকে তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে ধ্বংস হচ্ছে বনজসম্পদ। এক তথ্যানুযায়ী, প্রতি কিলোগ্রাম তামাক পোড়াতে প্রয়োজন হয় ৫ কেজি জ্বালানির। প্রতি মৌসুমে একরপ্রতি তামাক শোধনের জন্য লাগে ৫ টন জ্বালানি। এসব জ্বালানির জোগান আসে আম, কাঁঠাল, সেগুন, গর্জন, জাম, কড়ই প্রভৃতি বনজ ও ফলদ বৃক্ষ থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সচেতন মহলের সাথে আলাপে জানা যায়, প্রশাসনের নির্লিপ্ততার সুযোগে এ বছর চাষের পরিধি অনেক বেড়েছে। কৃষকরা টোবাকো কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে এ মৌসুমে কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও, চকরিয়া, রামু, বান্দরবান সদর, নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, থানছি ও রুমা উপজেলায় ফসলি ও বনভূমির প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ শুরু করেছে। প্রতি বছর তামাক চাষের পরিধি বাড়তে থাকায় আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকা উপজেলায় চরম খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে বলে দাবী করেছেন সচেতন মহল।
সম্প্রতি সরেজমিনে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ডাক্তার কাটা গ্রামে দেখা গেছে, বিষাক্ত তামাক ক্ষেতে দল বেঁধে কাজ করছে এক দল শিশু। ওদের মধ্যে আলাপ হয় তের বছর বয়সি স্থানীয় আবদুল করিমের ছেলে মো. ফারুকের সাথে। সে জানাল, পরিবার চালানোর জন্যই তাকে লেখা-পড়া না করে ক্ষেতে কাজ করতে হচ্ছে। কারণ বাবা কয়েক বছর আগে পরিবার ছেড়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে গেছে। সেখানে উনি নতুনকরে আবারো ঘর-সংসারে ব্যাস্থ হয়ে পড়েছে। এখন মা, তিন বোন এবং এক ভাইকে নিয়ে শিশু ফারুখ পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন কাজ করে সে ১৫০-২০০ টাকা পায়। পাশাপাশি তার মা রশিদা খাতুনও অন্যের বাড়িতে টাকার বিনিময়ে কাজ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু তালেব (২৫) এ প্রতিবেদককে বলেন, অল্প দামে কাজ সারানোর জন্যই তামাক কোম্পানিগুলো কৌশলে শিশুদেরকে শ্রমিক হিসাবে কাটাচ্ছেন। বর্তমানে গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে শত শত শিশু অল্প টাকায় তামাক ক্ষেতে কাজ করছে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে তাদের ভবিষ্যত জীবন। স্কুলপড়ুয়া শিশুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তামাক ক্ষেতে কাজ করছে। তারা তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও জানে না।
এদিকে জাতীয় শিশুশ্রম নীতি-২০১১ অনুযায়ী ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের শিশুরা কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুশ্রম দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এ আইন শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। এসব কাজে নিয়োজিত শিশুর বেশির ভাগই মানসিক ও শারীরিকসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছে। শিশুশ্রম আইন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, শিশুশ্রম বন্ধে মনিটরিং কমিটি গঠন করে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা বন্ধ করা সম্ভব। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে তাদের আরো সচেতন হতে হবে। এছাড়া আইন অমান্যকারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি এনজিগুলোকে ঋণ কার্যক্রমের সঙ্গে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করতে হবে। আর তা না হলে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না। শিশু নির্যাতন বাড়তেই থাকবে। গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী বলেন, তামাক ক্ষেতে কাজ করার ফলে প্রতি বছর এলাকার নারী এবং শিশুরা বিভিন্ন রুগে আক্রান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বনের কাঠ নিধন হওয়ায় হুমকির মূখে পড়ছে পরিবেশ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজর দেওয়া দরকার।
অন্যদিকে বন বিভাগের কর্মকর্তারাও ব্যাপকহারে বন উজাড়ের পেছনে তামাক চাষে উৎসাহদানকেই দায়ী করেছেন। বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ (ডিএই) এর তথ্য অনুসারে, গত ১০ বছরে জেলায় তামাক চাষ ৫ থেকে ৬ গুণ বেড়েছে। মূলত বেশি মুনাফার আশাতেই চাষিরা এই তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
ডিএই এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী চাষিরা প্রতি হেক্টর জমিতে সাধারণত ৭০ বেল (১ বেল সমান ৪০ কেজি) পরিমাণ তামাক পাতা উৎপন্ন করে থাকেন। সে অনুযায়ী বর্তমানে এই তামাক চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৫ হাজার হেক্টর জমি। এর ফলে প্রতি বছর পার্বত্য জেলাগুলোতে উৎপাদিত তামাক পাতার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লক্ষ ৫০ হাজার বেল। সাধারণত ‘তোনদুল’ হিসেবে পরিচিত চুল্লিতে ৭০ বেল তামাক প্রস্তুতের জন্য পোড়াতে লাগে ৪ টন জ্বালানি কাঠ। এর মানে প্রতিবছর ১০ লাখ ৫০ হাজার তামাক পাতা প্রস্তুতের কাজে পোড়াতে হচ্ছে ৬০ হাজার টন জ্বলানি কাঠ।
জানা গেছে, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় তামাক পাতা চাষের সবচেয়ে বড় খরিদদার হলো ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো (বিএটি), ঢাকা টোবাকো এবং আকিজ টোবাকো নামে প্রতিষ্ঠানগুলো। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হলো বিএটি। তারা চাষীদের তামাক চাষের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছে। ফলে এতদঅঞ্চলে শিশু শ্রম বৃদ্ধি ও বন উজাড়ের অন্যতম ভাগিদারও তারা।
Source: chttimes24.com