তামাক পণ্য আমদানি ও রফতানিতে অর্থ পাচার
তামাক পণ্য আমদানি ও রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন বনে গড়ে ওঠা তামাক শিল্প থেকে পণ্য আমদানির মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। পাশাপাশি বিদেশীদের বিক্রয় কমিশন দেয়াসহ নানা কৌশলে অর্থ পরিশোধ করছে দেশী প্রতিষ্ঠান। মূলত অর্থ পাচারের কৌশল হিসেবে তা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইউনিয়নের গবেষণা তথ্যমতে, বাংলাদেশে বছরে ১০ কোটি পিস সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য হচ্ছে, যা থেকে প্রতি বছর ২৪৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত যুগান্তরকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তামাক পণ্যের সবচেয়ে কম দাম বাংলাদেশে। অন্য দেশ থেকে চোরাই পথে এ পণ্য এনে এখানে বিক্রি করে লাভ নেই। এরপরও দেশে তামাক পণ্যের প্রচুর অবৈধ চালান ধরা পড়ছে। এর কারণ মিয়ানমার সীমান্তে বনগুলোতে অনেক তামাক পণ্যের শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে থাইল্যান্ড ও চীনও। তারা এমনভাবে তামাক পণ্য তৈরি করছে যা আসল ব্র্যান্ডের মতোই। দামও বাংলাদেশের তামাক পণ্যের মূল্যের চেয়ে ২০ ভাগ কম। যে কারণে এসব পণ্য দেশে ঢুকছে। হুন্ডিসহ বিভিন্ন কৌশলে এর মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে।
রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার : প্রতি বছর তামাক পণ্যের রফতানি বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫৪৪ কোটি টাকার তামাক পণ্য রফতানি করা হয়েছে। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। এ বাণিজ্য ঘিরে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দেখা গেছে, স্থানীয় শীর্ষস্থানীয় বিড়ি কোম্পানি নাসির বিড়ি দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অর্থ পাচার করছিল। প্রতিষ্ঠানটি বছরে অন্তত ৫শ’ কোটি টাকা পাচার করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুইজারল্যান্ডের টিটিএস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে নাসির বিড়ি বিক্রয় কমিশন বাবদ ২৭ লাখ টাকা (৩৫ হাজার ডলার) পাঠায় হুন্ডির মাধ্যমে। আরেক কোম্পানি হংকংয়ের এসপিসি ট্রেডিং লিমিটেডকেও একইভাবে ৩৯ লাখ টাকা (৫০ হাজার ডলার) পরিশোধ করে। এক্ষেত্রে সরকারি ডিউটির ১০ শতাংশ ফাঁকি দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি দুবাই এক্সপ্রেস থেকে কমিশনের টাকা পাঠানো হয়। এছাড়া মতিঝিলের এক বেসরকারি ব্যাংকের দুটি হিসাব থেকে বিভিন্ন তারিখে ১৫১ কোটি টাকা পাচারের নথি পেয়েছে দুদক। তামাক উৎপাদন, তামাকজাত পণ্য আমদানি-রফতানিতে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়। তবে প্রথম দফায় শুধু ৫৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে ৮ ফেব্র“য়ারি নাসির উদ্দিন বিশ্বাসসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
আমদানির নামে অর্থ পাচার : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশী তামাক পণ্যের অবৈধ চালান ঢুকছে দেশে। শুল্ক গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আসা ১৪ হাজার ১৭০ কার্টন অবৈধ সিগারেট আটক হয়েছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে একই সময়ে ১১ কোটি টাকার সিগারেট আটক হয়। এর মধ্যে একাধিক চালানের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতীয় নাগরিক আটক হয়েছে। এসব সিগারেটের মূল্য পরিশোধ করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৮ হাজার অবৈধ তামাক পণ্যের কার্টন আটক করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৯৭ কার্টন এবং ২০০৪-১২ অর্থবছর পর্যন্ত ৩ হাজার ২৯৭ কার্টন অবৈধ তামাক পণ্য (সিগারেট) আটক করা হয়েছে। ৪০টি দেশ থেকে অবৈধভাবে এসব তামাক পণ্য দেশে এসেছে। সবচেয়ে বেশি অবৈধ তামাক পণ্য আমদানি হচ্ছে মিয়ানমার থেকে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, সুইজারল্যান্ড, পাকিস্তান, জার্মানি, ভিয়েতনাম, জাপান, রাশিয়া, গ্রিস, দুবাই, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কুয়েত থেকেও আসছে।
তামাক পণ্যের অবৈধ বাণিজ্য : দ্য ইউনিয়নের তথ্যমতে, বিশ্বে তামাক পণ্যের বাণিজ্যের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ অবৈধ। এর মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে অবৈধ বাণিজ্য হচ্ছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নিুআয়ের দেশে এর হার ১২ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশে তামাক পণ্যের অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ হচ্ছে বছরে ৬৮৪ মিলিয়ন টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক পণ্যের শুল্কহার ও কাঠামো, মূল্য পার্থক্য ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা দুর্বল থাকার কারণে অবৈধ বাণিজ্য হচ্ছে। আর এ অবৈধ বাণিজ্যের আড়ালে বাড়ছে অর্থ পাচার।
Source: Jugantor,22 July,2015