কূটকৌশলের কাছে কৃষকের অসহায় আত্মসমর্পণ

সব কিছুই বোঝেন, জানেনও অনেক কিছুই, তারপরও কুষ্টিয়ার মিরপুরের আমনা ইউনিয়নের অঞ্জনগাছি গ্রামের কৃষক আলতাফ হোসেন তামাক চাষ করেন। মাঝে মাঝে রাগে ক্ষোভে নিজের চুল নিজেই ছিড়তে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু উপায় কি? ৮-১০ বছর ধরে ছয় বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন এই কৃষক। লাভ বেশি, সুবিধাও অনেক। এরকম লোভে পড়ে শুরু করেন এই চাষ। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন তামাক কোম্পানিগুলোর অপতৎপরতা, সেই সঙ্গে এর নানা দিকের ক্ষতি। বাড়তে থাকে চাওয়া-পাওয়ার ফারাক। কিন্তু ততদিনে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। নানা কারণে ইচ্ছে করলেও তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর যোগসাজশের ফাঁদে আমরা বন্দী হয়ে গেছি। এরকম চিত্র এই উপজেলার শত শত চাষীর। তামাকের দুষ্ট চক্রে বাধা পড়েছে তাদের জীবন। কোম্পানিগুলোর কূটকৌশলের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কিছুই করার থাকছে না তাদের। সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমনই চিত্র উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, তামাক চাষ যদি কৃষকরা করেন, তাহলে আমার কিইবা করার আছে। আমরা তো কৃষকদের জোর করে তামাক চাষ বন্ধ করতে পারি না। তবে অন্যান্য ফসলের যাতে চাষ বাড়ে সেজন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর উপজেলাসহ পুরো কুষ্টিয়া জেলায় বাড়ছে তামাক চাষ। একদিকে ধান, গম, আখ, আলু, পাটসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য চাষে কম লাভ, বিক্রিতে ফড়িয়া-আড়তদারদের দৌরাত্ম্য, ন্যায্য মূল্য পাওয়ার অনিশ্চয়তা এবং অপরদিকে তামাক চাষে অধিক লাভ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তাসহ তামাক কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাব এ জেলার প্রান্তিক কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে।
মিরপুরের চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা নানা দিক থেকে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রথম দিকে তামাক চাষের শুরুতেই কোম্পানিগুলো একর প্রতি ২ হাজার ৭০০ টাকা করে এবং দুই একরে ৫ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত নগদ টাকা ঋণ দেয়। বাকি সময় সার সরবরাহ করে। যেসব সার কোম্পানি সংগ্রহ করতে পারে না সেগুলো কেনার জন্য টাকা দেয়। কিন্তু ঋণ এবং সার মিলে আবাদ শেষে ব্যাংক এ্যাকাউন্টে টাকা দেয়ার আগেই কত কেটে নেয়া হবে এবং কোন কোন খাতে সেসব বিষয়ে এক ধরনের অন্ধকারে থাকেন কৃষক। যখন ব্যাংকে তামাক বিক্রির টাকা নিতে যায় তখন সেখানে উপস্থিত কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে জেনে নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হয়। এ সময় দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের মৌখিক হিসাব আর কোম্পানির কেটে নেয়া টাকার মধ্যে থাকে ব্যাপক ফারাক। কিন্তু ঝামেলা এড়াতে কোন প্রতিবাদ করতে পারেন না সরল কৃষক। কোন কোন সময় মৃদু প্রতিবাদ হলেও কুলিয়ে উঠতে পারেন না কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে। এভাবে কৃষকদের ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলে কোম্পানি। তারপর চাষ হওয়ার পর শুকানো বা পোড়ানো তামাক বিক্রির জন্য নিয়ে গেলে প্রথম প্রথম দু-তিন বেল তামাক এ-গ্রেড হিসেবে ধরে ১২৮ টাকা কেজিতে কিনে নেয়। কিন্তু তার পরই শুরু হয় টালবাহানা। কোন রকম মানদ- বা মাপকাঠি না থাকলেও শুধু তামাক কোম্পানির কর্মচারীদের ইচ্ছে মতো গ্রেড নির্ধারণ করে ৭০ টাকা কেজি পর্যন্ত বেচতে বাধ্য হন কৃষক। এখানেই শেষ নয়, কোন কোন সময় তামাক ক্রয় বন্ধ রাখে কোম্পানি। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েন কৃষক। এই ফাকে এক ধরনের (কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশকারী) দালাল বাড়ি বাড়ি ঘুরে কম দামে কিনে নেয় তামাক। কৃষকরাও বাধ্য হন বিক্রি করতে।
আবুল খায়ের কোম্পানির তালিকাভুক্ত চাষী এনায়েত জানান, তামাক এমন একটি পণ্য যা খাওয়া যায় না, বাড়িতে রাখলেও নষ্ট হয়। দুর্গন্ধে টেকা যায় না। অন্যদিকে যে পরিমাণ পরিশ্রম হয় সে তুলনায় দাম পাওয়া যায় না। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এমনকি ছেলের স্ত্রীরাও ব্যস্ত তামাক নিয়ে। রাত-দিন একাকার হয়ে যায়। নিজেকে দেখিয়ে কৃষক আজিজুল হক বলেন, এখন যেটুকু স্বাস্থ্য আছে তার অর্ধেক হয়ে যায় তামাক চাষের সময়। কিন্তু সে তুলনায় লাভ আসে না।
তামাক চাষের বিপরীতে বটতলা বাজারের কৃষক ইয়াসিন আলী জানান, এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে ব্যয় হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। মৌসুম শেষে ১২ থেকে ১৩ মণ ধান পাওয়া যায়। প্রতি মণ ধান ৫০০ (বর্তমান বাজার দর আরও কম) টাকা হলে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা হয়। এতে কোন লাভ তো হয়ই না বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হয়। এজন্য ১২ বছর ধরে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই তামাক চাষ করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে আবুল খায়ের টোব্যাকোর স্থানীয় দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, তামাকের গ্রেড আছে আটটি। এ বছর সর্বোচ্চ ১২৮ টাকা ও সর্বনিম্ন ৭৬ টাকা কেজিতে কেনা হয়েছে। তবে গ্রেড নির্ধারণ করে থাকেন কোম্পানির বায়াররা। অর্থাৎ তিন কোম্পানির (ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, আকিজ কোম্পানি ও আবুল খায়ের) রেট অফিসাররা মিলে গ্রেড নির্ধারণ করেন। এক্ষেত্রে তারা যেটি করেন সেটিই ঠিক। আমরা কিছু করি না।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কাগজে-কলমে তামাক চাষ কমছে দেখালেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সরকারী হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে পুরো কুষ্টিয়া জেলায় তামাক চাষ হয়েছে ১৬ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে। শুধু মিরপুর উপজেলায় চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু এ হিসাব মানতে রাজি নন কৃষকরা। তারা বলেন, পুরো কুষ্টিয়ায় প্রায় ২০-২২ হাজার হেক্টর জমির বেশি এবং মিরপুর উপজেলায় ৯-১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
সরকারী এ হিসাবের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ধান, গম ও পাট চাষে সরকারের নির্দেশনা থাকে এবং সেভাবেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও অর্জনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তামাক চাষে সরকারের কোন নির্দেশনা থাকে না। আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হবার জন্যই চাষীরা তাদের নিজ উদ্যোগে তামাকের আবাদ করে থাকে। তাছাড়া তামাক কোম্পানিগুলো চাষীদের তামাক চাষে বিভিন্ন আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ফলে এক ধরনের আইডিয়া করেই হিসাব করা হয়।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, তামাক একটি ক্ষতিকারক ফসল। এটি সবারই জানা। তারপরও এর চাষ বাড়ছে। পিছনের কারণ হচ্ছে অন্য ফসলে কৃষকরা মার খায়, ফলে সেই ক্ষতি পোষাতে তারা তামাক চাষ করেন। কিন্তু এটি করতে গিয়ে যে দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখেন না কৃষকরা। তবে সরকারীভাবে ইতোমধ্যেই অন্য ফসল চাষে প্রনোদনাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষকরা এক সময় হয়ত কোম্পানিরগুলোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদী হয়ে তামাক চাষ ছেড়ে দেবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাহিদা ও দাম আছে বলেই র্কষকরা এই চাষ করেন। এক্ষেত্রে গবেষকদের উচিত অধিক লাভজনক অন্য ফসলের জাত উদ্ভাবন করা এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উচিত তামাক চাষের ক্ষতির বিষয়ে চাষীদের পরামর্শ দেয়া।
গবেষণা সংস্থা প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান তামাক চাষ সম্প্রসারণে বহুজাতিক ও দেশীয় তামাক কোম্পানিগুলো সারাদেশে নানাবিধ কূটকৌশল ও আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। তবে দেশের সব জায়গায় তাদের আগ্রাসী চরিত্র ও কৌশল একরকম নয়। পার্বত্য জেলাগুলোতে কাঠের সুবিধা থাকায় সেখানে তারা চুল্লিতে কাঠ পুড়িয়ে চালাচ্ছে বন উজাড়ের আগ্রাসন। আবার আগ্রাসন ঢাকতে বনায়নের নামে প্রহসন করছে এবং জাতীয় বৃক্ষমেলায় অংশগ্রহণসহ নানা কৌশলে পুরস্কার আদায় করে নিজেদের দেশপ্রেমিক প্রমাণের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে। তামাক কোম্পানিগুলো বন উজাড় ও জমির উর্বরতা নষ্টের অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ধঞ্চে চাষের নামে সারা বছর জমিকে তামাকের দখলে রাখার অপতৎপরতা অবলম্বন করছে।
অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলে বন নেই তাই কাঠ পোড়ানোর আয়োজনও নেই, রোদে শুকিয়েই মূলত গুদামজাত করা হচ্ছে তামাক পাতা। এ অঞ্চলে তাদের মূল আকর্ষণ অতি উর্বর খাদ্যশস্যের জমি। কৃষি বিভাগের সকল সুবিধা অর্থাৎ সেচ, সার, বিদ্যুত ব্যবহার করে কৃষকদের মাধ্যমে তামাক চাষ করানো এবং ক্রমান্বয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ঘাঁটি বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গকে তামাক চাষের ঘাঁটিতে পরিণত করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য। দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ ভর্তুকিকৃত সার (ইউরিয়া ও টিএসপি) তামাক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় তা রীতিমতো

Source:Janakhantho,23 July,2015

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org