কৃষকের পুঁজি যাচ্ছে কোম্পানির পকেটে
ফাঁদে ফেলে কম দামে তামাক কিনে পুুঁজি গিলে খাচ্ছে চাষীদের। একই তামাক আবার রফতানি করে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ সহায়তার অর্থ। এতে একদিকে পুঁজি হারিয়ে কৃষক হচ্ছে নিঃস্ব। ঋণের দায় মেটাতে না পেরে কৃষক হচ্ছে গ্রামছাড়া। অপর দিকে বিধিবহির্ভূত নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। এই উভয় ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে লাভবান হচ্ছে গুটি কয়েক তামাক কোম্পানি।
মূল্য ফাঁদের প্রতারণার কৌশল জানা গেছে, তামাক চাষের জন্য খ্যাত কক্সবাজার চকরিয়া কারারা গ্রাম ঘুরে। আর নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য মহাহিসাব নিরীক্ষার প্রতিবেদন থেকে মিলছে।
এ প্রসঙ্গে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের প্রধান উপদেষ্টা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত যুগান্তরকে বলেন, কৃষি জমিতে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে হবে। এতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে এবং তা খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষায় সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, তামাক ও তামাক জাত পণ্যের ওপর উচ্চ হারে রফতানি শুল্ক আরোপ করতে হবে। তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে তামাক চাষের আওতাধীন কৃষি জমির পরিমাণ কমবে। এ জন্য প্রয়োজন একটি নীতিমালা। কক্সবাজার চকরিয়া উপজেলার কাকারা গ্রামের প্রায় দেড় হাজার কৃষক অনেকটা তামাক নির্ভর। যে কারণে লোকসান হলে এ চক্র থেকে এখানের কৃষকরা বের হতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই গ্রামে চারটি তামাক কোম্পানির নিবন্ধনকৃত ১২শ চাষী রয়েছে। এ বছর প্রতি কানিতে তামাক চাষে একজন কৃষককে ৩০ হাজার টাকার ওপরে লোকসান গুনতে হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা এ তথ্য জানিয়েছে। ফলে অনেক ঋণ নিয়ে তামাক চাষ করলে তা শোধ করতে পারেননি। যে কারণে অনেক চাষী গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মূল্য ফাঁদে কৃষক : সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বন্যার পানিতে অনেক তামাক কৃষকের ঘর থেকে ভেসে যাচ্ছে। কাকারা গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানান, এই সময়ে কৃষকের ঘরে তামাক থাকার কথা নয়। কিন্তু বিক্রি না হওয়ায় তা ঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, এ বছর কালো তামাক কোনো ভাবেই ক্রয় করেনি কোম্পানি, যা গত বছর একই তামাক ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে কিনেছিল। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এ বছর থেকে আর তামাক চাষ করবো না। গত ২০ বছর ধরে এ চাষ করছি। কিন্তু লোকসান ও স্বাস্থ্য খারাপ ছাড়া কিছু হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এ বছর কোম্পানির দেয়া বীজগুলো খারাপ ছিল। ওই গ্রামের কৃষক বাদশা মিয়া বলেন, কাকারার চাষীরা না মরে বেঁচে আছে এটি আল্লাহর রহমত। কোম্পানিগুলো তামাকের মূল্য ঘোষণা দিয়েছে ১৪৫ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে উৎপাদনের পর একজন কৃষক একশ কেজি পাতা বিক্রির জন্য নেয়ার পর ২০ কেজি পাতা কোম্পানির ঘোষিত দামে কিনেছে। বাকি ৮০ কেজি পাতা ৭০ থেকে ৮০ টাকার ওপরে মূল্য দেয়নি। তিনি আরও বলেন, নিজস্ব জায়গায় চাষ করার পরও আমার লোকসান হয়েছে। কিন্তু যারা জমি লিজ নিয়ে চাষ করেছেন তারা এ বছর মরে গেছেন।
বিধিবহির্ভূত নগদ সহায়তা লুটপাট : জানা গেছে, তামাক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বর্তমান কোনো নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে না। তবে এক সময় তা দেয়া হতো। কতিপয় কোম্পানি বাজার থেকে বিড়ি সিগারেট ক্রয় করে রফতানি করেছে। কিন্তু রফতানির সময় দেখানো হয় এসব সিগারেট ও বিড়ি নিজস্ব কারখানার উৎপাদিত এবং নিজস্ব জমির তামাক ব্যবহার করা হয়েছে। তাই কৃষি পণ্য দেখিয়ে সরকারের দেয়া নগদ সহায়তার অর্থ লুটপাট করে নেয়। গত ২ আগস্ট অনুষ্ঠিত সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটির বৈঠকে এ ধরনের একটি ঘটনায় ৬ কোটি ৩ লাখ টাকার নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয়ার অডিট আপত্তি তোলা হয়। জানা গেছে, এর আগেই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি উচ্চ আদালতে একটি রিট দায়ের করেছে। তবে নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অনুষ্ঠিত সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটি এ সংক্রান্ত দায়েরকৃত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ, হাতিয়ে নেয়া অর্থ পুনরায় আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। ওই বৈঠকের সভাপতিত্ব করে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর।
এছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে সর্বশেষ দাখিলকৃত ২০০৯-১০ সালের অডিট রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, আলিফ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি তামাক কোম্পানি একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করে নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ওই কোম্পানি বাজার থেকে বিড়ি ও সিগারেট ক্রয় করেছে। তা কৃষি পণ্য হিসেবে রফতানি দেখিয়ে ৫৬ লাখ টাকা নগদ সহায়তা হাতিয়ে নেয়। এ ঘটনাটি ঘটেছে ব্যাংক এশিয়ার এমসিবি দিলকুশা শাখা থেকে। অডিট রিপোর্টে বলা হয়, শিল্পকারখানায় প্রস্তুতকৃত সিগারেট, বিড়ি ও জর্দা কৃষি পণ্য নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কৃষি পণ্য দেখিয়ে তা রফতানি করে। এক্ষেত্রে নগদ সহায়তা প্রাপ্য নয়। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয় উচ্চ আদালতের রিট পিটিশনের সর্বশেষ ফলাফলের ওপর যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
Source: Jugantor,09 August,2015