থামছে না কোম্পানির আগ্রাসন : তামাক চাষ বন্ধে কৃষি জমি সুরক্ষা আইন প্রণয়নের তাগিদ
তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে রাষ্ট্রীয় কোনো নীতিমালা না থাকার সুযোগ নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। বিভিন্ন ক‚টকৈৗশলে এবং প্রলোভনে সহজ-সরল কৃষকদের মাধ্যমে তামাক চাষ বাড়িয়ে চলেছে। এতে দেশের কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়াসহ পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তামাক চাষ।
কৃষি জমির সুরক্ষা ও তামাক চাষ বন্ধে দ্রুত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে তামাকবিরোধী জোট ও সংশ্লিষ্ট মহলের পক্ষ থেকে। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রেখে কৃষি জমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইনের খসড়া তৈরি করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়া আইনে বলা হয়েছে কৃষি জমিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ফসলের (যেমন তামাক) উৎপাদন করা যাবে না। কৃষি জমি কেবল মাত্র কৃষি কাজেই ব্যবহার করতে হবে। এমনকি কৃষি জমিতে স্থাপনা নির্মাণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে খসড়া আইনে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে কৃষি জমি সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি হলেও আদালতে মামলার কারণে তা আটকে যায়। পরে আদালতের নির্দেশে বর্ধিত কমিটি নতুন করে খসড়া তৈরি করে। খসড়া আইনের ওপর চলতি মাসের শুরুতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়ে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য।
তামাকবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তামাক চাষ নিরুৎসাািহত করতে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে কোনো নীতিমালা নেই। তবে তামাক চাষে ব্যাংক ঋণ ও ভর্তুকির সার ব্যবহার বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ছোট ছোট কিছু উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো নানা ক‚টকৌশল, আর্থিক সুবিধা দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে তাদের আগ্রাসন।
সংশ্লিষ্টরা আরো বলেন, তামাক চাষের ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরে তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংাগঠন ও গণমাধ্যম কৃষি জমিতে তামাক চাষ বন্ধে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারিভাবে তেমন কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। এদিকে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে পাস হওয়া সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাক চাষে নিরুৎসাহিতকরণ সংক্রান্ত একটি ধারা সংযোজিত হলেও নীতিমালার অভাবে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, আইনের ১২নং ধারায় বলা হয়েছে ‘তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন ও উহার ব্যবহার ক্রমাগত নিরুৎসাহিত করার জন্য উদ্বুদ্ধ, এবং তামাকজাত সামগ্রীর শিল্প স্থাপন, তামাক জাতীয় ফসল উৎপাদন ও চাষ নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করিতে পারিবে।’ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এ কারণে দ্রুত কৃষি জমি সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সূত্রানুযায়ী দেশে চলতি (২০১৪) মৌসুমে ১০ লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে, গত (২০১৩) মৌসুমে যা ছিল ৭০ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে ৩৮ হাজার হেক্টর নতুন জমি তামাক চাষে যুক্ত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, তামাক চাষের এ পরিসংখ্যান পূর্ণাঙ্গ নয়। কেবল তামাক চাষের হটস্পট বা ঘাঁটিগুলোয় (কুষ্টিয়া ৪০ হাজার হেক্টর, বান্দরবান ২৬ হাজার হেক্টর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী ৩০ হাজার হেক্টর এবং রংপুর ১০ হাজার হেক্টর) আবাদকৃত জমি নিয়ে এ হিসাব তৈরি করা হয়েছে। আবাদি জমির পরিমাণ নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, নাটোর (চলনবিল), নড়াইল, যশোর ও পার্বত্য জেলাসহ বেশকিছু এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হলেও তা ওই হিসাবে যুক্ত করা হয়নি। সুতরাং সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব তামাকের জমির পরিমাণ সঠিকভাবে হিসাব করলে তা ১ লাখ ৮ হাজার হেক্টরের অনেক বেশি হবে। বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) এর তথ্যানুসারে ২০০৬-০৭ সালে দেশে তামাক চাষের মোট জমি ও উৎপাদিত তামাকের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩০ হাজার ৬৯৯.৪৫ হেক্টর ও ৩৯ হাজার ১৮০ টন এবং ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৮ হাজার ৮৬৭.৪১ হেক্টর ও ৭৯ হাজার ২৩৪ টন। অর্থাৎ ৪ বছরের ব্যবধানে তামাক চাষের জমি ও উৎপাদন উভয়ই বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এবং ২০১০-১১ (৪৮৮৬৭.৪১ হেক্টর, বিবিএস) সালের তুলনায় ২০১৪ সালে (১০৮০০০ হেক্টর, ডিএই) অর্থাৎ ৩ বছরের ব্যবধানে তামাক চাষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
যেসব এলাকায় বেশি তামাক চাষ হয় সেসব এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রমাগত তামাক চাষ করতে থাকা জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। গবেষকরা বলছেন, তামাক চাষে মাটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারণ ধানের চেয়ে তামাক চাষে তিনগুণ বেশি পরিমাণ ইউরিয়া সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তামাক চাষের জন্য একটি জমি ২ থেকে ৩ বার ব্যবহার করা যায়। তারপর এ জমিতে আর ভালো তামাক হয় না এবং অন্য ফসলের ফলনও ব্যাপকভাবে কমে যায়। বেশি পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হতে থাকে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি জমির সুরক্ষায় আইনটি দ্রুত প্রণয়নের দাবি উঠেছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে।
Source: bhorerkagoj, september 13,2015