আলীকদমে রবি শষ্যের জমি ছেয়ে যাচ্ছে আগ্রাসী তামাকের করাল থাবায়

বান্দারবানে আলীকদম পাহাড়ী দুর্গম উপজেলায় কৃষি জমিতে চলছে আগ্রাসী তামাক চাষের মহা সমারোহ। সরকারের ভর্তুকি দেয়া বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সার চলে যাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর তামাকের জমিতে। গত দেড় দশকের ও বেশি সময়ের ব্যবধানে উপজেলার প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমি দখল করে নিয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী আগ্রাসী তামাক চাষ।
আলীকদমের বুক চিরে দক্ষিন-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিম অভিমুখে বয়ে যাওয়া মাতামুহুরী নদীর দু-ধার তামাক চাষের কারণে হয়ে পড়েছে অরক্ষিত। মাতামুহুরী নদীর পানির স্তর থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত জমিতে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে তামাক চাষের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে থাকলেও তার কোন কার্যকরীতা দেখা যাচ্ছে না। পানি ছুঁয়ে প্রতিনিয়ত চাষ হয়ে চলেছে আগ্রাসী তামাক।
অন্যদিকে নদীর কুল ঘেষে রোপিত তামাক ক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও উদ্বেগজনক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নদী তীরবর্তি তামাক ক্ষেতের বিষাক্ত পানি গড়িয়ে পড়ছে নদীতে। এতে করে নদীর নানা প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত প্রায়। তাছাড়া তামাক থেকে নির্গত ক্ষতিকারাক গন্ধের কারণেও আশেপাশের পরিবেশসহ নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
এবিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মর্তুজা বলেন, নির্দিধায় বলা যায় এটা একটা ক্ষতিকারক বিষয়। আমি যেহেতু নতুন এসেছি। নদীতে মাছ মারা যাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে, আমি এবিষয়ে এলাকার জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, জেলে ও স্থানীয় মান্যগন্য ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করব এবং এর সমাধানের একটা উপায় খুজে বের করব।
আবাদি কৃষি জমির পাশাপাশি সরকারী বনভূমিতে ও তামাক চাষ মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যার কারণে এখানকার প্রাকৃতিক সবুজাভ পরিবেশ, পাহাড়-মাটি, নদী-খাল ও প্রাণী বৈচিত্র হারিয়ে যেতে বসেছে। তামাক পোড়ানোর জন্য সরকারী রিজার্ভ ফরেষ্ট থেকে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে কাঠ।
এখানকার তামাক কোম্পানীগুলো অতিরিক্ত আয়ের লোভ দেখিয়ে এবং লোভনীয় হারে লোন দিয়ে তামাক কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এক একর জমিতে ধান চাষ করে কৃষকের আয় হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। যে জমিতে ধান চাষ করে ১৫-২০ হাজার টাকা পাওয় যায় সেখানে তামাক চাষে আয় হয় দ্বিগুণ অর্থ। ধান চাষের চেয়ে তামাক ক্ষেতে খাটুনির পরিমাণ বেশী হলেও দ্বিগুণ আয়ের লোভে সবাই ঝুঁকছে ক্ষতিকারক তামাক চাষের দিকে। চিকিৎসকদের মতে, তামাক চাষের কারণে কৃষকরা বার্জাস-সহ নানা রোগে ভূগছে।
তামাক ক্ষেতে অতিরিক্তক ইউরিয়া সার, নানা ধরণের বিষ ও কীটনাশক প্রয়োগ করার কারণে তামাক চাষীরা চর্মরোগ, হাপানীসহ নানা রোগে ভূগেন।
উপজেলায় ব্যাপকভাবে তামাক চাষের কারণে রবিশস্যের জমি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে এলেও প্রতিবছরই বাড়ছে বিপুল অঙ্কের সরকারি ভর্তুকি দেয়া সারের বরাদ্দ। সরকারের ভর্তুকি দেয়া বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সার চলে যাচ্ছে টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর তামাকের জমিতে। তবে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো বলছে, এ খাতে ব্যবহার করার জন্য তারা নিজস্ব উদ্যোগে সার আমদানি বা কারখানাগুলো থেকে চড়া দামে সার সংগ্রহ করছে।
কৃষি সংশিস্নষ্টদের মতে, তামাক চাষ মাটির প্রাণশক্তি একেবারেই নিঃশেষ করে দেয়। আলীকদমের একজন সাবেক কৃষি কর্মকর্তা তাঁর গবেষণায় জানান, কৃষকরা জমিতে উপযুক্ত শস্য বিন্যাস না করে তামাক চাষ করে চলেছে। ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় এখানকার বিস্তির্ণ কৃষি জমিতে সবুজ সার, সরিষা ও ডাল জাতীয় ফসল উৎপাদন হতো। যার পুরোটাতেই এখন আধিপত্য বিস্তার করছে আগ্রাসী তামাক। তামাকের কারণে জমিতে অসম মাত্রায় ইউরিয়া সারের উদ্বেগজনক প্রয়োগ, বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ বালাইনাশকের এলোপাথাড়ি ব্যবহার চলছে। যার ফলে ভুমি হারাচ্ছে তার প্রাণশক্তি এবং প্রকৃতি হারাচ্ছে সজীবতা। তামাকের করালগ্রাসে জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে থাকা সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদী নাব্যতা হারিয়েছে অনেক আগে। যা এখনো অব্যহত।
প্রতিবছর লামা বন বিভাগের মাতামুহুরী রিজার্ভের বিস্তীর্ণ বন ভূমিতে বন আইন উপেক্ষা করে তামাক চাষ হচ্ছে। গত ৩-৪ বছর বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারীর কারণে মাতামুহুরী রিজার্ভে তামাক চাষ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। উৎপাদিত হাজার হাজার মণ তামাক কিউরিং করতে সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর নির্মাণ করা হয় শত শত তন্দুর (চুল্লি)। এসব চুল্লিতে জ্বালানী হিসেবে পোড়ানো হয় কাঠ। এসব কাঠ স্থানীয় বনভূমি থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে বনাঞ্চল।
স্থানীয় লোকজন জানান, দরিদ্র কৃষকদের কোম্পানীরা লোভের ফাঁদে ফেলে তামাক চাষে নিয়োজিত করছে। বর্তমানে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তামাক সুস্থ পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর চাষ। তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বতার ও নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং বন-জঙ্গলের জীববৈচিত্র হুমমির মধ্যে পড়েছে। এ ব্যপারে কথা বলেছিলাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী আহামদ এর সাথে, তিনি জানান, আমাদের ইউরিয়া সার তামাকের জমিতে ব্যবহারের খবর পাওয়া গেলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং তামাক চাষিদেরকে তামাক চাষ থেকে নিরুৎসাহিত করে বিকল্প হিসাবে চিনা বাদাম, তরমুজ, আখ, আলু ইত্যাদি চাষে উৎসাহিত করে আসছি। গত বছর ৪৮০ হেক্টর জমিতে রবি শষ্য চাষ হয়েছে। চলতি বছরের হিসাব আমরা এখনো চুড়ান্ত করিনি তবে আমার বিশ্বাস ২০১৫ সালে এর পরিমান আরো বাড়বে।

Source:bccnews24.com,২/০১/১৫

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org