শৈশব গিলে খাচ্ছে তামাকের বিষ

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শিশুদের তামাক চাষ থেকে শুরু করে কারখানা পর্যায়ে কাজ করতে দেখা গেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি গবেষণাকে উদ্বৃত করে গবেষণা সংস্থা প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৫টি বিড়ি কারখানা রয়েছে, যেগুলোতে ৭৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।

এর মধ্যে লালমনিরহাটের নয়টি বিড়ি কারখানায় প্রায় ২১ হাজার শ্রমিকের ৭০ শতাংশই চার থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশু। আর রংপুরে ৩০টি বিড়ি কারখানায় প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিকের অর্ধেকই শিশু, যাদের বয়স চার থেকে ১২ বছর।

এর বাইরে ‘পারিবারিক শ্রমের’ অংশ হিসাবে বিপুল সংখ্যক শিশু তামাক চাষ এবং বিড়ি তৈরিতে জড়িয়ে আছে, যাদের সংখ্যার কোনো হিসাব নেই।

জেলার আদিতমারি উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়ন এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে পারিবারিক শ্রমের অংশ হিসেবে শিশুদের তামাক চাষের নানা ধাপে কাজ করার তথ্য মিলেছে।

সারপুকুর ইউনিয়নের যুবক মো. শাহীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাপের সাথে পোলা তো ক্ষেতে কাজ করবই। বাপ যদি তামাক গাড়ে পোলা কী করব? আর বাপেও কী করব? অন্য ফসলে দাম নাই। তামাক না গাড়লে কেমনে চলব?”

গত ১৬ জানুয়ারি লালমনিরহাটে আকিজ গ্রুপের বিড়ি কারাখানায় শত শত শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়।

প্রতিদিন প্রায় ৯০-৯৫ লাখ শলাকা বিড়ি উৎপাদনকারী এ কারখানায় কার্ডধারী শ্রমিকদের কেউ ‘শিশু নয়’ বলে কারখানার ম্যানেজার মো. আবু তাহের দাবি করলেও কার্ডের বাইরে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক সেখানে কাজ করে বলে স্বীকার করেন তিনি।

“দেখা যায়, ভাইয়ের সাথে ভাই এসে কাজ করে। বাবা-মার সাথে ছেলে কাজ করছে।”

তবে এদের মধ্যে কতজন শিশু সে সম্পর্কে কোনো ধারণা তিনি দিতে পারেননি।

কারখানার একটি শেডের সুপারভাইজার নূরুল আলম জানালেন, শিশুদের নামে আলাদা কার্ড দেওয়া হয় না। তাদের কাজ যোগ হয় মা-বাবার কার্ডে।

এ কারণে শিশুদের নাম হাজিরা খাতায় নেই দাবি করলেও খাতা দেখাতে তিনি অস্বীকার করেন।

এ কারখানায় সপ্তাহে ছয় দিন (১০০০ শলাকা) কাজ করলে বোনাস হয় বলে জানান তিনি। বাবা-মার পরিবর্তে সন্তান কাজ করে দিলেও বোনাস দেওয়া হয় বলে জানান নূরুল আলম।

কারখানায় সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে শিশুশ্রমিকদের বিভিন্ন পথে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ কাজে মো. আজিজার ‍রহমান নামে একজনকে বেশ সক্রিয় দেখা যায়।

তিনিই আবার কারখানাটিতে ‘কোনোভাবেই শিশুশ্রম হয় না’ বলে দাবি করতে থাকেন বার বার। তবে এক পর্যায়ে আজিজার স্বীকার করেন, উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণে ‘হেল্পার’ নেওয়ার নিয়ম এ কারখানায় রয়েছে।

শিশুদেরকে কারখানা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন মান পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। তাড়িয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওদের কারণে ওদের মা-বাবার কাজের ক্ষতি হয়। তাই তাড়িয়ে দিচ্ছি।”

শিশুদের সামনেই তিনি বলেন, “এরা কাজ করে না।”

সাকিবুল নামে দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী তার বাবা মফিজুলের সঙ্গে এ কারখানায় কাজ করে। বাবা-ছেলে দুজনেরেই ভাষ্য, পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে সাকিবুল এই কাজ করে।

এ সময় পাশ থেকে এক শ্রমিক জানান, সাকিবুল আসলে লেখাপড়া করে না, বাবার সঙ্গে কারখানাতেই কাজ করে।

কারখানার ব্যবস্থাপক মো. আবু তাহের এক প্রশ্নের জবাবে দাবি করেন, তামাকের কাজ করলে শিশুদের ক্ষতি হয় না, অন্তত তিনি দেখেননি।

কিন্তু রংপুরের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন মো. আমিনুল ইসলাম সরকার বলছেন, প্রক্রিয়াজাতকরণের যে কোনো পর্যায়েই তামাকের গুঁড়োর কারণে শিশুদের নানা রোগ হতে পারে।

“তামাক চাষ বেশি হয়, এমন এলাকা থেকেই বেশি রোগী আসে,” বলেন এই চিকিৎসক।

রংপুরে আকিজের আরেকটি বিড়ি কারখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা নিয়ে ২০১৩ সালে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট রুল দিয়েছিল। পরে আর শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানান রিটকারীর আইনজীবী বিএম ইলিয়াস কচি।

শ্রম আইন অনুসারে ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশুদের কোনো কাজেই নিয়োগ করা যাবে না। আর এ আইনের অধীনে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ’ হিসেবে চিহ্নিত বিড়ি ও সিগারেট তৈরিতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের নিয়োগ করা যাবে না।

 

২০১৩ সালের মার্চে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিড়ি ও সিগারেট বানানোর কাজ করলে শিশুদের ফুসফুসের রোগ, পাকস্থলিতে ঘা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত সমস্যা, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।

তামাক শুকানো ও প্রক্রিয়াকরণ, বিড়ি ও মোড়ক তৈরি করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাজ করা, তামাকের গুঁড়ো ও নিকোটিনের সরাসরি সংস্পর্শে কাজ করা, শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে ক্ষতিকর পদার্থ শরীরে ঢুকতে পারে, এমন কাজে ১৮ বছরের কম বয়সীদের নিষিদ্ধ করা হয় ওই প্রজ্ঞাপনে।

এছাড়া ১২ বছর কম বয়সীদের কোনো কাজে নিয়োগ না দিতে বিচারপতি মো. ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১১ সালে একটি রায় দিয়েছিল। শিশুদেরকে কাজে না দিয়ে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষায় রাখতেও বলা হয়েছিল ওই রায়ে।

‘ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ানক’সহ সব কাজ থেকে কর্মজীবী শিশুদের প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে ২০১০ সালে করা শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালাতেও।

আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব খোন্দকার মোস্তান হোসেন বলেন, “আমাদের নানামুখী তৎপরতায় শিশুশ্রম কমেছে। তবে হ্যাজার্ডাস কাজে শিশুরা এখনও রয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক খাতে শিশুদেরকে যাতে নিয়োগ না দেওয়া হয়- সেটাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।”

তামাক খাতে শিশুশ্রমের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

Source: bdnews24.com,Published: 2016-01-30 

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org