তামাক শিল্পমালিকদের দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত

বাইরে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। ভেতরে তামাক শিল্পসংশ্লিষ্টদের সাথে রাজস্ব কর্মকর্তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি চরমভাবে উপেক্ষিত। তালিকায় লেখা, ুদ্র শিল্পোদ্যোক্তাদের সাথে এনবিআরের প্রাক-বাজেট আলোচনা। বাস্তবে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তামাক পণ্যের ভাগ্য নির্ধারণ। সকালের বৈঠক হয় বিকেলে। বিকেলে নির্ধারিত বৈঠক সম্পন্ন হয়ে যায় আগের দিনই। এনবিআরের এক পাশে তামাকবিরোধীদের গণ-অবস্থান। অন্য পাশে বিড়ি শ্রমিকদের মানববন্ধন। প্রতি বছর এপ্রিল মাস এলেই মঞ্চস্থ হয় এমন অসংখ্য খণ্ডনাটক। পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের আগে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায় তামাক শিল্পমালিকদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তামাকপণ্যে অধিক হারে করারোপ ঠেকাতে বাজেটের আগে প্রতিবারই নানামুখী উদ্যোগ নেয় শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বিড়ি শিল্পমালিক সমিতি। অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপিদের সাথে ঘন ঘন বৈঠক করা, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে একাধিক বৈঠক করা, স্থানীয় এমপিদের মাধ্যমে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার ইস্যু করানো, সরকারের নীতিনির্ধারকদের নানা উপায়ে আবোল-তাবোল বোঝানো, শিল্প ধ্বংসের আতঙ্ক ছড়িয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামানো, বিদেশী সিগারেটে বাজার সয়লাব হয়ে যাচ্ছে মর্মে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করানোসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন শিল্পমালিকেরা।
জানা যায়, গত ২৪ মার্চ ছিল এনবিআরের সাথে সিগারেট ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্ধারিত বৈঠক। সংবাদ পেয়ে নির্ধারত সময়ের আগেই সুশীলসমাজের লোকদের সাথে নিয়ে এনবিআরের সামনে মানববন্ধন শুরু করে তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন। তামাকবিরোধী সংগঠন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, এসিডি, ইপসা, সীমান্তিক, উবিনীগ, ইসি বাংলাদেশ, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট, নাটাব, বিসিসিপি, প্রত্যাশা, এইড ফাউন্ডেশন ও প্রজ্ঞা। স্বাভাবিক কারণেই সকালের নির্ধারিত বৈঠক মুলতবি হয়ে চলে যায় বিকেলে। যদিও এর আগেই ৩০ মার্চ এনবিআরের সাথে বৈঠক করে তাদের দাবিগুলো জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ বিড়ি শিল্পমালিক সমিতির নেতারা। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে এনবিআরকে চারটি বিষয় বিবেচনার অনুরোধ করেছেন সমিতির সভাপতি বিজয় কৃষ্ণ দে। দাবিগুলো হলো, বিড়ির ওপর আরোপিত শুল্কহার কমানো, সিগারেটের চতুর্থ বিন্যাসটি বাতিল অথবা প্রতি শলাকা সিগারেটের সর্বনি¤œ মূল্য ৫ টাকা নির্ধারণ করা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিকেল-৬ অনুসরণ করে সিগারেটের সর্বনি¤œ শুল্ক ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করা এবং সর্বশেষ বিড়ির ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর বাতিল করা।
কেবল আইন প্রণয়নে বাধাদান নয়, বিদ্যমান আইন অমান্য করার ক্ষেত্রেও তামাক কোম্পানিগুলো অত্যন্ত বেপরোয়া। তামাকবিরোধী কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে বেরিয়ে এসেছে আইন আমান্যের ভয়াবহ এ চিত্র। দেশের প্রচলিত আইনে বিড়ি, সিগারেট, গুল, জর্দাসহ সব ধরনের তামাকপণ্যের ক্ষেত্রেই প্যাকেট বা কৌটার ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র সতর্কবাণী প্রকাশ বাধ্যতামূলক। গত ১৯ মার্চ থেকে চালু হওয়া এ আইন অমান্যকারীর ক্ষেত্রে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ গবেষণায় দেখা যায়, বাজারে বহুল বিক্রীত ১৪ ব্র্যান্ডের ৮৮টি বিড়ির প্যাকেটের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে একটিতেও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নেই। ১০০ কোম্পানির ২০৮টি ব্র্যান্ডের ৬৩৯টি জর্দার কৌটার মধ্যে সতর্কবাণী পাওয়া গেছে মাত্র ১৪টিতে। আর ১৪ কোম্পানির গুলের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে সচিত্র সতর্কবাণী ছাপা আছে মাত্র একটিতে।
অথচ বিশ্বের ৮০টি দেশে তামাকজাত দ্রব্য ও সিগারেটের প্যাকেটে ধূমপানের ফলে মানবদেহের কী কী তি হতে পারে, সে সংবলিত ছবি দেয়া সতর্কবাণী মুদ্রণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ভারতে সিগারেটের প্যাকেটের মোড়কের সামনে এবং পেছনে ৮৫ শতাংশ স্থানজুড়ে সচিত্র সতর্কবার্তা সংযোজন করার আইন হয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটের মোড়কে সতর্কবার্তার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে নেপালে ৯০ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় প্যাকেটের সামনে ৭৫ শতাংশ এবং পেছনে ৯০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় সামনে পেছনে ৮০ শতাংশ। সম্প্রতি এক নির্দেশনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলতি বছরের ২০ মের মধ্যে ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি সদস্য রাষ্ট্রকে সিগারেটের প্যাকেটে থাকা সতর্কবাণী প্যাকেটের ৬৫ শতাংশজুড়ে রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে। কানাডার পার্লামেন্ট সিগারেটের প্যাকেটে এ ধরনের সতর্কতা বাণী বাধ্যতামূলক করেছে ২০০১ সালে।
অধিক হারে শুল্ক আরোপ ঠেকাতে তামাক কোম্পানিগুলোর তৎপরতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা: সৈয়দ মাহফুজুল হক এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, বাজেটকে সামনে রেখে তারা ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী এনবিআরের সাথে দুইবার করে বৈঠক করেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি অনুযায়ী এসব বৈঠক প্রকাশ্যে হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের দেশে তা মান্য হয় না। তাদের দাবির পক্ষে এমপিদের কাছ থেকে ডিও লেটার সংগ্রহ করা শুরু হয়ে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে আমরা হয়তো আরো অনেক কর্মসূচি দেখতে পাবো।
তিনি বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকদের নানাভাবে মিসগাইড করার চেষ্টা করছে। তারা বোঝাতে চাচ্ছে, অধিক হারে করারোপ করা হলে তামাকপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। দাম বাড়লে ভোক্তারা তামাক সেবন ছেড়ে দেবেন এবং তাদের শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ বাস্তবতা হলো, চাহিদা-জোগানসংক্রান্ত অর্থনীতি সাধারণ সূত্রটি এখানে কার্যকর হয় না। দাম বাড়লেই সব মানুষ রাতারাতি তামাকপণ্য গ্রহণ ছেড়ে দেবে না। বরং কার্যকর উপায়ে শুল্ক আরোপ করা গেলে শিল্পও উপকৃত হবে, সরকারের রাজস্বও বাড়বে। আবার তামাকের ব্যবহারও ধীরে ধীরে কমে আসবে।
ডা: সৈয়দ মাহফুজুল হকের সাথে একমত প্রকাশ করেন বিড়ি শিল্পমালিক সমিতির সভাপতি বিজয় কৃষ্ণ দে। বিদ্যমান করব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, এর ফলে বিড়িশিল্প দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভুল নীতির কারণে একজন ধূমপায়ী মাত্র ২ টাকায় সিগারেটের খেতে পারছে। এর মাধ্যমে সিগারেট সেবন এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আসন্ন বাজেটে সবধরনের সিগারেটের ওপর ৭০ শতাংশ স্পেসিফিক ডিউটি (এসডি) আরোপ করে ধ্বংস প্রায় বিড়ি শিল্পকে রক্ষার দাবি জানান তিনি।
যদিও তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর দাবি একটি সমন্বিত শুল্ককাঠামো। আসন্ন বাজেট উপলক্ষে গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী বরাবরে দেয়া স্মারকলিপিতে তারা বলেন, অবিলম্বে তামাকের বিদ্যমান শুল্ককাঠামোর পরিবর্তে কার্যকর তামাক শুল্কনীতি প্রণয়ন করতে হবে। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর শুল্কারোপের মাধ্যমে প্রতি বছর তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে হবে যাতে তামাকপণ্য ক্রমশ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। আগামী বাজেটে সিগারেটের মূল্যস্তরভিত্তিক কর-প্রথা বাতিল করে প্যাকেট প্রতি খুচরা মূল্যের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ পরিমাণ স্পেসিফিক এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করতে হবে। বিড়ির ট্যারিফ ভ্যালু তুলে দিয়ে প্যাকেট প্রতি খুচরা মূল্যের ৪০ শতাংশ পরিমাণ স্পেসিফিক এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করতে হবে। গুল-জর্দার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পরিমাণ স্পেসিফিক এক্সাইজ ট্যাক্স নির্ধারণ করতে হবে। তামাকের ওপর আরোপিত স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে।

Source: Nayadiganta,28 April, 2016

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org