স্তরভিত্তিক কর কাঠামোই রাজস্ব ফাঁকির হাতিয়ার
তামাক পণ্যের কর-সংক্রান্ত নীতিমালার অভাবে বিরাট অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ফলে তামাকজাত পণ্য সস্তা হওয়ায় মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য হারে করারোপ হয়নি। এতে সস্তা হচ্ছে তামাক পণ্য। সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে শুধু মূল্যস্তর ও ভিত্তিমূল্য সমন্বয় করার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ফলে সিগারেট-বিড়ির প্রকৃত মূল্য দিন দিন কমছে। বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তামাক পণ্যের দাম সবচেয়ে কম। ফলে লাফিয়ে বাড়ছে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, একটি কোম্পানি মূল্যস্তর কম দেখিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তা প্রমাণ হওয়ায় পরিশোধের নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার মতে, বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের ওপর বিদ্যমান কর কাঠামো জটিল। এখানে তামাকের রাজনীতি জড়িত। জটিল কর কাঠামোর কারণেই কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সিগারেটের ক্ষেত্রে চার মূল্যস্তরভিত্তিক কাঠামো, ভিন্ন ভিন্ন মূল্যস্তরের ওপর ভিন্ন ভিন্ন হারে কর, ভ্যাট ও করারোপের ভিত্তি কর কাঠামোকে জটিল করে তুলেছে। এ জটিল কর কাঠামোর সুবিধা পাচ্ছে তামাক কোম্পানি আর বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। তামাক পণ্যের ওপর অধিকহারে কর বাড়ানোর বিকল্প কিছু নেই। তা ছাড়া সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর তুলে দিতে হবে। এক ধাপের সিগারেটের দাম বাড়লে মানুষ অন্যটিতে যেতে পারে। এ জন্য যখন সব তামাক পণ্যের দাম বাড়বে তখন এর ব্যবহার কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ মহল তামাক পণ্যে যৌক্তিক করারোপের দাবি করেছেন। বিশেষ করে স্তরভিত্তিক কর কাঠামো তুলে দেওয়ার দাবি তাদের। তারা উল্লেখ করেছেন, স্তরভিত্তিক কর কাঠামো থাকায় কোম্পানিগুলো বেশি মূল্যের সিগারেট আমদানি করে কম মূল্যস্তরে দেখিয়ে কর ফাঁকি দেয়। এ জন্য করস্তর তুলে দেওয়া উচিত।
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের মূল্যভিত্তিক স্তর ও তার ওপর করারোপের বর্তমান পদ্ধতি বিলোপ করা প্রয়োজন। তার প্রত্যাশা, আগামী অর্থবছরে এ স্তর উঠে যাবে। তিনি বলেন, মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি সিগারেটের কর ও মূল্য। ফলে সেবনকারীর সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ছে। সেদিকে নজর রেখে বাজেটে কর বসানো উচিত।
৩০-৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকারস সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তামাককে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল অর্থাৎ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক অর্থমন্ত্রী তামাকে করারোপের ক্ষেত্রে আগামী বাজেটে মূল্যস্তরভিত্তিক কর প্রথা তুলে দিয়ে তামাকের কর-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, তামাকের কর কাঠামো পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, চার স্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তর থাকায় কোম্পানিটি বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ পেয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, চার স্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তরের পরিবর্তে একটি মূল্যস্তর রাখার। এতে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকবে না, এক স্তরে বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে।
চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে সিগারেটের ওপর চারটি মূল্যস্তর বিদ্যমান। এই স্তরগুলোর ওপর বিভিন্ন মূল্যস্তরভিত্তিক সম্পূরক করের হার ৪৮ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত। ১৫ শতাংশ মূসকসহ করভার দাঁড়ায় ৬৩ থেকে ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত। বিড়ির ক্ষেত্রেও শলাকার পরিমাণভেদে ভিন্ন ভিন্ন কর হার প্রযোজ্য। বিড়ির ধরন-ফিল্টারযুক্ত ও ফিল্টারবিহীন ভেদে কর ধার্য করা হয়। বাস্তবে এখন ‘ফিল্টারযুক্ত’ বিড়ির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
তামাকের কর-সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তামাক পণ্যের ওপর ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হলে এক বছরে বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৬০ কোটি শলাকা সিগারেট ও বিড়ির ব্যবহার কমবে এবং তামাক খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব অর্জিত হবে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতিবছর সিগারেট ও বিড়ির প্রকৃত মূল্য কমছে।
Source: dainik amader shomoy,11 May, 2016