তামাকে পুড়ছে পাহাড়ি বনও
জীবিকার জন্য পাহাড়ের উপর নির্ভরশীল নন জয়নুল আবেদীন, তবুও প্রতিদিন পাহাড়ের দিকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকেন এ জেলে।
বছরের পর বছর যে নদীতে মাছ ধরে জীবন চালিয়ে আসছেন, পাহাড়ের মাটি সেই মাতামুহুরীর দুকূল ভরাট করে ফেলছে। বদলে যাচ্ছে নদী, সঙ্গে মাছের আবাসস্থলও।
“পাহাড়ের মাডি আসি নদী ভরি গেছে, এহন মাছ কই পামু?”
পঞ্চাশোর্ধ্ব জয়নুলের বাস কক্সবাজারের চকরিয়ার জেলেপল্লীতে; মাছ ধরেন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চকরিয়া ব্রিজের আশপাশের উজান-ভাটিতে। ওইখান থেকেই দেখা যায় চকরিয়ার কাকাড়া ইউনিয়নের পাহাড়গুলো।
কেন মাটি আসে- এ প্রশ্নে স্বল্পভাষী এই জেলে বলেন, “তামুকের জন্য গাছ কাইটলে মাটি আইসবে না? এজন্যিই তো তামুকের ক্ষেতের পাশে মাছ হয় না।”
ভরাট হয়ে যাওয়া নদীতে বছরে ৮-১০টি ‘ঢল’ কূল ছাপিয়ে উঠায় মাছ ধরতে সমস্যার কথা জানান জয়নুল। বলেন, জীবিকার জন্য আর কোনো কাজ না করায় এখন পেশাও ছাড়তে পারছেন না।
“বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মাছ ধরি। আর কোনো কাম করি নাই। এহন এমুন অবস্থা, কোনো কোনোদিন ৩০ টাকার মাছ নিয়াও ফিরতে অয়।”
লেখাপড়া না জানা এ জেলে এক সময় পরিবার নিয়ে ‘সুখে দিন কাটাতেন’, তখন নদীর দুই পাশে ছিল ঘন জঙ্গল। আর এখন তামাক পোড়াতে গাছ কাটার ক্ষতি পোহাচ্ছেন, থেকে থেকে পুরনো দিনের কথা ভেবে ফেলছেন দীর্ঘশ্বাস।
জয়নুলের মত ওই এলাকার আরও বাসিন্দাদের অভিযোগ, তামাক চাষের জ্বালানি হিসেবে গাছের ব্যবহারের কারণেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে থাকা দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে, বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।
টোবাকো অ্যাটলাসের দেওয়া এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বনউজাড়ের ৩১ ভাগের জন্য তামাক চাষকে দায়ী করা হয়েছে।
যার প্রভাবে গত এক শতাব্দীতেই দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ৫০ ভা বন ‘হারিয়ে গেছে’ বলে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ফরেস্ট্রি রিসার্চের অন্য এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
নদীর পাড়ে চর; তামাক পেড়াতে গাছ নিধনই এর কারণ বলে অভিযোগ নদীর পাড়ে চর; তামাক পেড়াতে গাছ নিধনই এর কারণ বলে অভিযোগ
চকরিয়ার মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবও বন উজাড়ের পেছনে তামাক চাষকেই প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, “মাতামুহুরি আর সাঙ্গুর দুই পাশের পার্বত্য অঞ্চলে এখন খালি তামাক। এই তামাক চাষ পাহাড়ি বনকে শেষ করে দিয়েছে।”
নিজেও একসময় তামাকচাষী ছিলেন মাহবুব। আশির দশকের শুরুতেই এলাকায় প্রথম তামাক চাষের গোড়াপত্তনের করেন তিনি, এজন্য পরিচিতও হয়ে উঠেছিলেন ‘পাতা মাহবুব’ নামে। কিন্তু পাহাড়ের প্রতি টান সেই চাষের প্রতি বিরূপ করে তুলেছে তাকে।
“আমার গ্রামের উত্তর অংশ থেকেই ঘন বন ছিল বড় বড় গাছ ছিল, নানান পশুপাখি ছিল। বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িতেও যেতাম আমরা। এদিকে পাহাড় মানেই বুঝতাম বন আর বন।”
তামাক চাষে পোড়ানোর জন্য গাছ কাটার প্রয়োজন দেখা দিতেই এ পেশা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন মাহবুব; যদিও তাতে বনধ্বংস ঠেকানো যায়নি।
“পাহাড়ে ঢুকলেই বন আর বন দেখতে পেতাম, এই বন কখনও শেষ হবে; লাকড়ি, কাঠ, বাঁশ কিনতে হবে-কেউ ভাবেনি। আর এখন মাইলের পর মাইল হাঁটলেও দুইটা বাঁশ পাওয়া যায় না। তামাক সব পুড়িয়ে ফেলেছে, ঘরে দেওয়ার জন্য দুইটা বাঁশ লাগলেও অনেক দামে কিনতে হচ্ছে।”
এ ইউনিয়নের পাহাড়েই এক সময় আদিবাসী রাখাইনদেরও অনেকগুলো পরিবার ছিল বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব।
“শিয়াল, হরিণ, বানর, শুকরও ছিল বেশুমার। বাঘ ভাল্লুকেরও দেখা মিলত। এখন এগুলোর কিছু নেই।”
বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের তথ্য মতে, ২০১২ সালে কেবল কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ৪ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
২ একর জমিতে চাষ হওয়া তামাক পোড়ানোর জন্য প্রতি মৌসুমে যে তন্দুর (তামাকচুল্লি) ব্যবহৃত হয় তাতে ১০ টন কাঠ জ্বালানি হিসেবে লাগে। সেই হিসেবে ওই বছর তামাকের জ্বালানি হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টন কাঠ।
তামাক প্রক্রিয়ার কাজে চাষিরা তামাক প্রক্রিয়ার কাজে চাষিরা
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজারের ৩৮৩৮ একর জমিতে তামাকের চাষ হয়। প্রতি মৌসুমে এ বিপুল পরিমাণ কাঠের চাহিদাই গিলে খাচ্ছে বনাঞ্চলকে।
চকরিয়া পেরোলেই পার্বত্য বন। সেখানেও হানা দিয়েছে তামাক ব্যবসায়ীরা। অন্যান্য এলাকায় সরাসরি তামাকের চাষ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং মেহেরপুর ও কুষ্টিয়াতে বেশি চলে তাপশোধিত তামাক চাষ। এজন্য দরকার কাঠের। তামাক ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি তখন যায় বনের দিকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ষাটের দশকে বাংলাদেশে তামাক চাষ শুরুর পরই পার্বত্য চট্টগ্রামেও চাষ শুরু হয়েছিল।
তবে এই তামাকে ঠিক কী পরিমাণ গাছ উজাড় হয়-সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন এক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচক ব্যবহার করেন।
প্রজ্ঞার তথ্য অনুসারে, কেবল ২০১৪ সালে বান্দরবনে প্রায় ৬ হাজার তামাকচুল্লী স্থাপন করা হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বরাত দিয়ে তামাকবিরোধী এই সংগঠনের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে তামাক থেকে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭০ লাখ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। রপ্তানি বৃদ্ধির এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় বাংলাদেশে তামাক চাষ কী পরিমাণে বাড়ছে।
“সাঙ্গু নদীর দুই ধারে খালি তামাকের চাষ এখন। পাহাড়ের অন্য এলাকার অবস্থাও একই। আর সব চাষের কাঠ আসে পাহাড়ের বন থেকে,” বলেন সাঙ্গু নদীতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নৌকা চালানো হারুন-অর-রশিদ।
থানছি থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটক নিয়ে যান তিন্দু, রেমাক্রি, বড় মদকে যান এ মাঝি। জানান, বছর বছর ধরে গাছ কাটার ‘মহোৎসবের’ কথা।
“বিভিন্ন এলাকায় টার্গেট করে বন থেকে বিপুল পরিমাণ গাছ কাটা চলছে।”
আসবাবের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বন ধ্বংসের অন্যতম কারণ হলেও তামাক চাষেই সর্বনাশ হচ্ছে, মন্তব্য তার।
হারুনের মতো পাহাড়ের সব মানুষের অভিযোগের তীরও একইদিকে। গাছ কেটে বন ধ্বংস করে পাহাড়ের ‘চরিত্র’ বদলে দেওয়ার এ ‘চেনা উপায়’ বদলাতে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানোরও দাবি তাদের।
“এক সময় এখানে পাহাড়ে ছিল বন। আর ফসলের ক্ষেতে তরি-তরকারি। তরকারি উৎপাদনের জন্য এই এলাকা বিখ্যাত ছিল,” বলেন দীঘিনালার স্বপন কিশোর বড়ুয়া।
নিধনের পর পাহাড়ে এখন বৃক্ষ নেই, আছে কিছু গুল্ম নিধনের পর পাহাড়ে এখন বৃক্ষ নেই, আছে কিছু গুল্ম
পরিবহন বিভাগে চাকরি করার সুবাদে কিশোর ঘুরেছেন পুরো পার্বত্য এলাকায়; জানালেন, তামাক চাষের ছোবলে পাহাড় থেকে সব্জিচাষও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
“তামাক চাষ আসার পর প্রথমে সবজির ক্ষেত দখল করেছে। এরপর চাষ হওয়া তামাক পোড়ানোর জন্য পাহাড় ন্যাড়া করতে থাকে। আগে দিঘীনালার তরি-তরকারি চট্টগ্রামেও চলত; আর এখন এখানেই সবাইকে বেশি দামে তরকারি কিনে খেতে হয়।”
মেরং ইউনিয়নের পূণ্যমনি চাকমা বললেন প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরা ‘স্বপ্নের’ অতীতের কথা।
“এই এলাকায় এক সময় পালা ছাগলের পালের মতো বন্য শুকর, ভাল্লুক ও হরিণ দেখা যেত। বাঘও চোখে পড়ত প্রায়ই। জমিতে বা পাহাড়ে কাজ করতে বা অন্য কোথাও যেতে মানুষকে যেতে হত দল বেঁধে।”
কাঠ ব্যবসা, ব্রিকফিল্ড আর তামাক চাষের কারণে সেই বন হারিয়ে গেছে, দীর্ঘশ্বাস তার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ১৯৭১-৭২ সালে ১৬৭০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। তখন প্রধানত রাঙামাটিতে তামাক চাষ হলেও আশির দশকের প্রথম দিকে তামাক চাষ ছড়িয়ে পড়ে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে।
৯০ দশকে রাঙামাটিতে তামাক উৎপাদন কমলেও বেড়ে যায় বান্দরবন ও খাগড়াছড়িতে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বান্দরবনে ৫ হাজার ৩শ’ ৬২ একর, খাগড়াছড়িতে এক হাজার ৫শ’ ৬১ একর এবং রাঙামাটিতে ৫শ’ ৩১ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
এর বাইরে নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও মানিকগঞ্জ জেলায় বড় পরিসরে তামাক চাষ হয় হলে বিবিএসের পরিসংখ্যানে বলা হয়।
Source: bdnews24.com