আইন লঙ্ঘন করে ব্র্যান্ডিংয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় বিএটিবিসির
তামাকজাত দ্রব্য উত্সাহিত করে এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫-এর সর্বশেষ সংশোধনীতে। তামাক কোম্পানিগুলোর সব ধরনের ব্র্যান্ডিং নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তা লঙ্ঘনে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে আইনে। যদিও ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ের নামে প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করছে এ খাতে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড (বিএটিবিসি)। সর্বশেষ ২০১৫ হিসাব বছরেও ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ে ১৯৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে কোম্পানিটি।
সরাসরি বিজ্ঞাপন ও প্রচার না করলেও নিজস্ব বিক্রয়কর্মী, বিক্রয়কেন্দ্র ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএটিবিসি পরোক্ষভাবে এ ব্যয় (ব্র্যান্ড মার্কেটিং) করছে বলে জানিয়েছে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)। তবে বিএটিবিসির দাবি, আইনের মধ্যে থেকেই ব্যবসা করছে তারা।
তামাকজাত দ্রব্যের সব ধরনের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধনী, ২০১৩)-এর ৫ ধারায়। ধারাটিতে বলা হয়েছে, যেকোনো গণমাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার, বিনামূল্যে তামাকজাত দ্রব্য বিতরণ, দান, পুরস্কার প্রদান বা অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার গ্রহণ, তামাকজাত দ্রব্য বা প্যাকেটের আদলে অন্য কোনো পণ্য উৎপাদন বা বিতরণ, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য বা প্যাকেট প্রদর্শন করা যাবে না। একই ধারার উপধারা-৩-এ বলা হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক ও প্রতীক ব্যবহার করে কোনো ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিও পালন করা যাবে না।
আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাকের ব্যবহার প্রবর্ধনের উদ্দেশ্যে যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম ‘তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
সরাসরি বিজ্ঞাপন না বললেও ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ের নামে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ ব্যয় করছে বিএটিবিসি। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে তামাক ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনের আগে ব্র্যান্ড মার্কেটিং ও ট্রেড মার্কেটিংয়ের নামে বিজ্ঞাপন ও প্রচারে আলাদা করে অর্থ ব্যয় করত বিএটিবিসি। পরে একই খরচকে দ্বিগুণে উন্নীত করে ব্র্যান্ড মার্কেটিং খাতে ব্যয় দেখানো হচ্ছে। ২০১৫ সালে এ খাতে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ১৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি এ খাতে ব্যয় করে প্রায় ১৭৫ কোটি ২৩ লাখ। এর আগে ২০১৩ সালে ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ে ৭৩ কোটি ও ট্রেড মার্কেটিংয়ে ৭১ কোটি ৮১ লাখসহ মোট ১৪৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়েছিল কোম্পানিটি। ২০১২ সালেও দুই খাতে ৬৭ কোটি ৭১ লাখ ও ৬১ কোটি ৮০ লাখ টাকাসহ মোট ১২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে তারা। আর ২০১১ সালে ব্র্যান্ড মার্কেটিং ও ট্রেড মার্কেটিংয়ে বিএটিবিসি ব্যয় করে ২০২ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং ২০১০ সালে প্রায় ১১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএটিবিসির কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আজিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএটিবিসি সবচেয়ে বেশি কমপ্লায়েন্ট। আইন লঙ্ঘন করে কোনো ব্যবসা করছে না কোম্পানিটি। তামাকবিরোধী আইন হওয়ার পরই সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাজারজাতকরণে সব পণ্যেরই ব্র্যান্ডিং খরচ থাকে। তামাকজাত পণ্য নিষিদ্ধ না হওয়ায় এর বিক্রিতেও অভ্যন্তরীণ কিছু ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম রয়েছে।
বিএটিবিসি ব্র্যান্ড মার্কেটিং ব্যয়কে সরাসরি বিজ্ঞাপন না বললেও আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী পরোক্ষভাবে তারা এটি করছে। এনটিসিসির কো-অর্ডিনেটর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. রুহুল কুদ্দুস এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাকপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এমন সব কাজ বিজ্ঞাপন হিসেবে পরিগণিত হবে। কোম্পানিগুলো সরাসরি বিজ্ঞাপন না দিলেও পরোক্ষভাবে এ কাজটি করে যাচ্ছে। কোম্পানিটি অভ্যন্তরীণভাবে হোক আর প্রকাশ্যে হোক— যেভাবেই ব্র্যান্ড মার্কেটিং করুক না কেন, তা আইনত অবৈধ।
সরাসরি বিজ্ঞাপন না দিলেও পরোক্ষভাবে বিএটিবিসির তামাকজাত পণ্যের প্রচারণার একাধিক চিত্র তুলে ধরেছে প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) নামে একটি তামাকবিরোধী সংগঠন। তারা দেখিয়েছে, সরাসরি বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ থাকায় সিগারেটের ছোট ছোট সুদৃশ্য পোস্টার দিয়ে দোকান সজ্জিত করে কোম্পানি। সিগারেটের প্যাকেটসদৃশ বড় আকৃতির ডামিও দোকানে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পাশাপাশি ঝুলিয়ে রাখা হয় নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেটসদৃশ বোর্ড।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অফিসার মাহফুজুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএটিবিসিসহ সিগারেট কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক অনেক শক্তিশালী। আইনে অনেক কিছু বলা থাকলেও এদের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়। বিএটিবিসি অনেক বড় ও বহুজাতিক কোম্পানি হওয়ায় তারা সরাসরি বিজ্ঞাপন প্রচার না করলেও বিভিন্ন কৌশলে তা অব্যাহত রেখেছে। নিজস্ব কর্মী ও বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে তা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
উল্লেখ্য, দেশে সিগারেট শিল্পে মোট বিক্রির দুই-তৃতীয়াংশ আসে বিএটিবিসি থেকে। সিগারেটের মূল্য বাড়ায় কোম্পানির টার্নওভারও নিয়মিত বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বিএটিবিসির মোট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট প্রদান শেষে কোম্পানির নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের একই সময়ের চেয়ে এ পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বেশি।
Source: bonik barta,27 December, 2016