এসডিজি বাস্তবায়নে বড় বাধা তামাক
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে অন্যতম বড় বাধা তামাক। এসডিজির প্রায় প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তামাক বড় ধরনের বাধা। এসডিজি অর্জন করতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতীয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকার পর্যায়ক্রমে এসব লক্ষ্যসমূহ পূরণ করবে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করে জাতিসংঘ। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য, অসাম্য ও ক্ষুধা দূরসহ ১৭টি ক্ষেত্রে বিশ্বকে এগিয়ে নিতে ১৬৯টি নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব এসডিজির শুধু তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রাতেই (সুস্বাস্থ্য) নয়, বরং ১৭টি ক্ষেত্রেই রয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা প্রগতির জন্য জ্ঞানের (প্রজ্ঞা) গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য নির্মূল এসডিজির প্রথম লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে তামাক শক্তিশালী বাধা। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে একটি পরিবারের মাসিক খরচের ৫ ভাগ ব্যয় হয় তামাকে; যা অন্যান্য দারিদ্র্য দূরীকরণ কাজে ব্যয় করা যায়। তামাকজনিত অসুখে প্রতিটি পরিবারকে তাদের মাসিক খরচের ১০ ভাগ ব্যয় করতে হয়, যা আয়-দারিদ্র্য ও মানব-দারিদ্র্যকে ত্বরান্বিত করে।
দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রা ক্ষুধামুক্তি। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকি সৃষ্টি করছে তামাক চাষ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে তামাক চাষের আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার একর।
তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা সুস্বাস্থ্য। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিঙ্ অ্যান্ড ইভালুয়েশন, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, ২০১৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী তামাকের কারণে দেশে বছরে ৯৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তামাকের ভয়াবহতা প্রতিহত না করলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।
চতুর্থ লক্ষ্যমাত্রা মানসম্মত শিক্ষা। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের অর্ধেকই শিশুশ্রমিক, যারা শিক্ষাবঞ্চিত এবং চরম দারিদ্র্যের শিকার। তামাক চাষ ও তামাক বিক্রির সঙ্গেও একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশুশ্রমিক জড়িত রয়েছে, যারা শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
পঞ্চম লক্ষ্যমাত্রা লিঙ্গ সমতা। এক্ষেত্রে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব যেভাবে প্রতিবন্ধকতা করতে পারে, সে বিষয়ে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি নারী পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। এ ছাড়া তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী।
একাদশ লক্ষ্যমাত্রা টেকসই শহর ও তার অধিবাসীদের নিরাপদ রাখা। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাংলাদেশে শহরে বসবাসরত প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ পাবলিক প্লেসসমূহে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। এই হার গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।
ত্রয়োদশ লক্ষ্যমাত্রা জলবায়ুবিষয়ক পদক্ষেপ। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বন উজাড়। সারা পৃথিবীর দুই থেকে চার শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী তামাক চাষ।
চতুর্দশ লক্ষ্যমাত্রা পানির নিচে প্রাণ। এক্ষেত্রে তামাক যেভাবে প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে বলা হয়েছেÑ ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশসহ ৯২ দেশের সাগর থেকে যে বর্জ্য সংগ্রহ করে তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে সিগারেট ফিল্টার। সিগারেট ফিল্টার পচে মিশে যেতে ১২ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। তাই তা দীর্ঘ সময় ধরে সাগরে দূষণ সৃষ্টি করে।
পঞ্চদশ লক্ষ্যমাত্রা স্থলভাগের জীবন। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ধানের চেয়ে তামাক চাষে ৩ গুণ বেশি ইউরিয়া সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ২০১১ সালের তুলনায় বর্তমানে তামাক চাষের জমি ৩ গুণ বেড়েছে।
অন্যদিকে তামাক পোড়ানোর ফলে বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ বন উজাড় হয়ে থাকে। সুতরাং তামাকপণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারজনিত ক্ষতি প্রভৃতি সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে সেগুলোর সবই এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। অর্থাৎ এফসিটিসি বাস্তবায়ন না করতে পারলে তামাক দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভিত দুর্বল করে ফেলবে এবং এর ফলে টেকসই উন্নয়ন অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে।
সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) তামাক একটি বড় বাধা। আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে চাই। এই ঈপ্সিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমরা যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করছি, সেগুলো হচ্ছেÑ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবহার করে একটি তহবিল গঠন করা, যা দিয়ে দেশব্যাপী জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। আমরা তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করব। এর উদ্দেশ্য হবেÑ দেশে তামাকজাত পণ্যের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং একই সঙ্গে এ অঞ্চলের সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি করা। সর্বোপরি, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের আমাদের সময়কে বলেন, তামাক উন্নয়নের জন্য বাধা। আর প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সেটি করতে হলে উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ জন্য যে কয়েকটি ইন্ডিকেটর রয়েছে। তার মধ্যে উচ্চতর শুল্ক অন্যতম। এ জন্য আগামী বাজেটে সে বিষয়টি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
Source: Dainik amader shomoy, April 22, 2017