বিএটিবির ১৯২৪ কোটি টাকা কর ফাঁকি
মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ১৯২৪ কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। ২০০৯-২০১০ থেকে ২০১২-২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে কম্পানিটি কর বাবদ ওই পরিমাণ অর্থ সরকারকে কম দিয়েছে উল্লেখ করে তা চেয়ে বসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর ওই টাকা যাতে না দিতে হয় সে জন্য হাইকোর্টে মামলা করেও হেরে গেছে কম্পানিটি। এ অবস্থায় কম্পানিটির পক্ষে সমঝোতার চেষ্টায় নেমেছেন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি দিয়ে বিএটিবিকে যাতে ওই টাকা দিতে না হয় সে জন্য আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
হাইকোর্টে মামলায় হেরে যাওয়ার পর বিএটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেহজাদ মুনিম ঘটনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে অ্যালিসন ব্লেকের কাছে চিঠি লিখে এই অর্থ যাতে সরকারের কোষাগারে দিতে না হয় সে জন্য তাঁর হস্তক্ষেপ চান।
এমনকি বিএটিবির মূল শেয়ারহোল্ডার ব্রিটিশ কম্পানি রালি ইনভেস্টমেন্ট কম্পানি লিমিটেড বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশন’-এ মামলা দায়ের করবে বলে হুমকি দিয়েছে।
অ্যালিসন ব্লেককে লেখা চিঠিতে বিএটিবির এমডি বলেছেন, ‘এনবিআর যে ১৯২৪ কোটি টাকা দাবি করছে, তা কম্পানিটির এক বছরের কর-পরবর্তী মুনাফার তিন গুণেরও বেশি। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সব কর্মকর্তার সঙ্গেই যোগাযোগ করেছি। আলোচনাকালে তাঁরা সবাই স্বীকার করেছেন যে এটি একটি হয়রানিমূলক ঘটনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় বিএটিবি বিচার পেতে ব্যর্থ হয়।
বিএটিবি বিষয়টি হাইকোর্টে নিয়ে গেলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ মামলায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এত গুরুত্ব তিনি আগে কখনো দেননি। হাইকোর্টও সামান্য অর্থ সমন্বয় করে এনবিআরের দাবির পক্ষেই রায় দিয়েছেন। ’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাইকোর্টের রায়ের পর বিএটিবি আপিল বিভাগে আপিল করেছে। পাশাপাশি ব্রিটিশ হাইকমিশনারের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে তদবির চালাচ্ছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। তাই এ ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে সমঝোতার সুযোগ নেই। তা সত্ত্ব্বেও সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি পাঠিয়ে সমঝোতা বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব করেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) ইস্যুতে লিখছি, এ বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বেও একাধিকবার আলোচনা করেছি। আমি আশাবাদী, আপনার অফিস বিষয়টি সমাধানে আন্তরিক। ’
‘আপনি হয়তো জানবেন, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সিগারেট বিক্রির পুরনো ঘটনায় এনবিআর বিএটিবির কাছে ১৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট দাবি করেছে। বিষয়টি ২০১৫ সালের পর হাইকমিশনের নজরে আনা হয়েছে যে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এ বিষয়ে আইনগত মতামত দিয়েছে—সিগারেট হলো কনজ্যুমার পণ্য, যার দামের মধ্যেই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেহেতু সিগারেট বিক্রির সময়ই তা পরিশোধ করা হয়, তাই পূর্ববর্তী ঘটনার প্রেক্ষাপটে উৎপাদকের (বিএটিবি) ভ্যাট দাবি করার কোনো সুযোগ ছিল না’—যোগ করেছেন হাইকমিশনার।
হাইকমিশনার চিঠিতে আরো বলেছেন, ‘আমি বুঝতে পারছি যে আদালতের বাইরে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে এনবিআর যাতে আইন মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করেন সে জন্য আপনি চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো কারণে ওই সব মিটিং অনুষ্ঠিত হয়নি। ’
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কাছ থেকে এই চিঠি পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী তা এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) কমিশনার (ভ্যাট) মতিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ বিএটিবির কাছে এনবিআরের ১৯২৪ কোটি টাকা পাওয়ার পক্ষে হাইকোর্টের রায় রয়েছে। এ মামলা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ অবস্থায় কারো আবেদনে কিছু করার নেই। এটি আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হতে হবে।
আদালতের বাইরে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ব্রিটিশ হাইকমিশনারের অনুরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে গত বুধবার ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশন জানায়, ‘আমরা ফাঁস হওয়া কাগজপত্রের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করি না। ’ একই সঙ্গে হাইকমিশন জানায়, ‘ব্রিটিশ সরকার যুক্তরাজ্যের সব ব্যবসাকে সহযোগিতা দেয় এবং তাদের জন্য স্বচ্ছ, অনুমানযোগ্য ও বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানায়। ব্রিটিশ সরকার বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ’
এ বিষয়ে কথা বলতে বিএটিবির কম্পানি সচিব আজিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। কম্পানিটির চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার আখতার আনোয়ার খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা ফয়েজ আলীর মোবাইল নম্বর দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
ফয়েজ আলী গত বুধবার মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএটিবির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে চাইলে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠাতে হবে। তাঁর দেওয়া ই-মেইল ঠিকানায় বুধবার বিকেল ৫টা ৫৪ মিনিটে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠিয়ে মোবাইল ফোনে এসএমএস করার পর তিনি ফিরতি এসএমএস দিয়ে জানান, ‘আমি অফিসের বাইরে আছি। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আপনাকে কল দেব। ’ তবে বৃহস্পতিবার তিনি ই-মেইলের জবাব দেননি। ফোনও করেননি।
এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিএটিবি জাতীয় বাজেটে নির্ধারিত মূল্যস্তর থেকে এক ধাপ নিচের স্তরে নামিয়ে এনে ব্রিস্টল ও পাইলট ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি করে। মূল্য কমিয়ে ফেলায় এ দুটি ব্র্যান্ডের সিগারেট থেকে সরকারের রাজস্বও কমে যায়। এনবিআর হিসাব করে দেখতে পায়, ব্র্যান্ড দুটির মূল্য না কমিয়ে আগের স্তরে রাখলে কম্পানিটির কাছ থেকে ২০০৯-২০১০ থেকে ২০১২-২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত অতিরিক্ত ১৯২৪ কোটি টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পাওয়া যেত। দাম কমানোর ফলে এই পরিমাণ রাজস্ব কম পেয়েছে এনবিআর। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বোর্ড থেকে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর এই অর্থ দাবি করে বিএটিবিকে নোটিশ দেয় এনবিআর। তাতে উল্লেখ করা হয়, মিথ্যা ঘোষণা ও তথ্য দিয়ে সরকারকে এই পরিমাণ রাজস্ব কম দিয়েছে বিএটিবি।
অ্যালিসন ব্লেককে লেখা চিঠির অনুলিপি অর্থমন্ত্রীকেও দিয়েছিলেন বিএটিবির এমডি শেহজাদ মুনিম। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘ইতিমধ্যে সার্বিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আদালতের দিকনির্দেশনা মেনে নতুন দাবি তাদের কাছে পাঠাতে হবে। ’
অর্থমন্ত্রীকে লেখা অ্যালিসন ব্লেক ও বিএটিবির এমডির চিঠির তথ্যানুযায়ী, ১০৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে সিগারেট উৎপাদক ও বিপণনকারী কম্পানিটি। বিএটিবি বাংলাদেশে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। কম্পানিটিতে সরকারসহ বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ১৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কম্পানিটির ৭২.৯১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ব্রিটেনের রালি ইনভেস্টমেন্ট কম্পানি লিমিটেড। গত বছর কম্পানিটি একক কম্পানি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেছে।
Source: kaler kantho, 19 August, 2017