জর্দা-গুলের ব্যবসায় রাজস্ব ফাঁকির খোঁজে এনবিআর
রহমত রহমান: দেশে প্রায় সাড়ে ৪০০-এর বেশি ব্র্যান্ডের জর্দা-গুল রয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব গুল-জর্দা দেদার বিক্রি হয়। কিন্তু সরকার জর্দা-গুল থেকে রাজস্ব পায় না। তাই জর্দা-গুল কারখানা খুঁজে বের করে রাজস্ব আদায়ে পদক্ষেপ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির মাধ্যমে ফাঁকি খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী কাউস মিয়ার কাউস কেমিক্যাল, শাহজাদা সেলিম প্রডাক্ট, জাহাঙ্গীর কেমিক্যাল, এ কাদির ঈগল টোব্যাকোসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে এনবিআর।
সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের নির্দেশে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর জর্দা-গুল কারখানায় অভিযান চালায়। এর মধ্যে মূসক গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ হুমায়ুন হাফিজের নেতৃত্বে বংশাল এলাকার জাহাঙ্গীর কেমিক্যাল ওয়ার্কসের দুটি প্রতিষ্ঠান, শাহজাদা সেলিম প্রডাক্টের (গুল) একটি ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় এ কাদির ঈগল টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডের একটি কারখানায় অভিযান চালানো হয়। এতে চারটি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র জব্দ করা হয়। চারটি প্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে রাজস্ব দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে জব্দকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়। চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
মেসার্স জাহাঙ্গীর কেমিক্যাল ওয়ার্কসের বিরুদ্ধে প্রায় ৩৯ লাখ টাকার সম্পূরক শুল্ক, প্রায় ১১ লাখ টাকার মূসক ও প্রায় ৭৫ হাজার স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জসহ প্রায় ৫০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির মামলা করা হয়। ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি জাহাঙ্গীর শোভা জর্দা, পাতা শোভা জর্দা, তুফান জর্দা, মর্দ জর্দা ব্র্যান্ডের জর্দাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গুল প্রস্তুত ও বাজারজাত করে আসছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে রাজস্ব পরিশোধ না করে গুদামজাত করে সুবিধাজনক সময় তা বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ পান কর্মকর্তারা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির জব্দ করা জর্দার পণ্যমূল্য যাচাই করে প্রায় সাড়ে ২২ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির আরও একটি মামলা করা হয়।
এ কাদির ঈগলের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ২২ লাখ টাকার সম্পূরক শুল্ক, প্রায় সাত লাখ টাকার ভ্যাট ও প্রায় ২২ হাজার টাকার সারচার্জসহ প্রায় ২৯ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির মামলা করা হয়। ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি গুগল ব্র্যান্ডের গুল প্রস্তুত ও বাজারজাত করে আসছে। পরে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি স্বীকার করে প্রায় ২৯ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। মেসার্স শাহজাদা সেলিম প্রডাক্টের (গুল) বিরুদ্ধে প্রায় ১৭ লাখ টাকার সম্পূরক শুল্ক, প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ভ্যাট ও প্রায় ৫৬ হাজার টাকার সারচার্জসহ প্রায় ২৩ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির মামলা করা হয়। ভ্যাট পশ্চিম কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি স্বীকার করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। এছাড়া সাত্তারের শাহজাদি জর্দাসহ বেশ কয়েকটি জর্দা-গুল কোম্পানির ফাঁকি উদ্ঘাটনে কাজ করছে মূসক গোয়েন্দা নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।
অন্যদিকে, পুরান ঢাকার কাউস কেমিক্যাল ওয়ার্কসের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ পায় এনবিআর। পরে মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষার জন্য বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ কাগজপত্র তলব করে। পরে তা পর্যালোচনা করে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টাকার উৎসে ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করে। ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটি হাকিমপুরী, মানিক জর্দা ব্র্যান্ডের জর্দা প্রস্তুত ও বাজারজাত করে আসছে। জর্দা তৈরির উপকরণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত নয়Ñএমন প্রতিষ্ঠান থেকে উপকরণ ক্রয়ের মাধ্যমে এ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এ ভ্যাট পরিশোধে ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনারেট দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে। কাউস কেমিক্যালের মালিক কাউস মিয়া প্রতি বছর এনবিআরের সেরা করদাতা হিসেবে সম্মাননা পেয়ে আসছেন।
এনবিআর সূত্র জানায়, সম্প্রতি এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স সারাদেশে ৩২টি ব্র্যান্ডের গুল ও ৪২১টি ব্র্যান্ডের জর্দা কোম্পানির একটি তালিকা তৈরি করে। এসব জর্দা ও গুল কোম্পানি সঠিকভাবে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ পরিশোধ করছে কি না, তা যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে সব ভ্যাট কমিশনারেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি কমিশনারেট তালিকা প্রস্তুত করে এনবিআরে প্রেরণ করেছে। সম্প্রতি টাস্কফোর্স-সংক্রান্ত সভায় কমিশনাররা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু জর্দা ও গুল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ও বিআইএন নেই। ফলে প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা কষ্টকর। প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী মেশিনপত্র না থাকায় নিবন্ধন গ্রহণের পর কর আরোপের জন্য চাপ দেওয়া হলে দ্রুত স্থানান্তরিত হয়ে যায়। ফলে রাজস্ব আদায় সম্ভব হয় না।
মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা টাস্কফোর্সের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, মূসক গোয়েন্দা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে রাজস্ব ফাঁকির মামলা করেছে। কিছু মামলা প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া ভ্যাট কমিশনারেটগুলো নিয়মিত অভিযান ও মামলা করছে। কঠোর পদক্ষেপের ফলে কিছু ফলাফল আসতে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর জর্দা-গুলসহ ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে খুব একটা রাজস্ব আদায় হতো না। চলতি অর্থবছর আদায় বেড়ে যাবে।
Source: sharebiz, 28 Oct, 2018