শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে অনুদান গ্রহণের বিনিময়ে বিএটিবি’কে সুবিধা প্রদান- এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ মানছেনা সরকার

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ‘বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর কাছ থেকে ২ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ পর্যন্ত ২৩ কোটি ৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৮০ টাকা অনুদান গ্রহণ করেছে। তামাক কোম্পানি থেকে এ ধরনের অনুদান গ্রহণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর আর্টিকেল ৫.৩ গাইডলাইনের ৪.১০ এর পরিপন্থী, যেখানে তামাক কোম্পানি থেকে কোন প্রকার অনুদান, উপহার অথবা দান গ্রহণ করার বিষয়ে সরকারকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত এফসিটি কনফারেন্স অব পার্টিস এর তৃতীয় অধিবেশনে র্টিকেল ৫.৩ সংক্রান্ত গাইডলাইন গ্রহণ/অনুমোদন করা হয়, সুতরাং বাংলাদেশের জন্য গাইডলাইনটি বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতি বছর ‘শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে’ অনুদানের চেক হস্তান্তরের খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করেছে বিএটিবি, যেন কোম্পানিটির জন্মই হয়েছে শ্রমিক কল্যাণের জন্য, তামাক বিক্রির জন্য নয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ও এসংক্রান্ত খবর ছবিসহ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় প্রচার করেছে। এছাড়াও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক যেমন: মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিব, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এর সাথে বিএটিবি’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয় যা আর্টিকেল ৫.৩ গাইডলাইনের ২ এর পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বিএটিবি কে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পরোক্ষভাবে তামাক কোম্পানির ইতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে যা জনস্বার্থবিরোধী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘২০৪০ সাল নাগাদ তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ সংক্রান্ত চেতনার পরিপন্থী।

শ্রমিক কল্যাণের নামে এই অনুদানের বিনিময়ে বিএটিবি বছরের পর বছর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে শ্রম স্বার্থবিরোধী সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫টি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বিএটিবি-কে ‘জনস্বার্থে’ বিভিন্ন মেয়াদে (টেবিল ১) বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ধারা ০৬, ০৯, ১০০, ১০২, ১০৪, ১০৫ ও ১১৪ (১) এর বিধানের প্রয়োগ হতে শর্তসাপেক্ষে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। মূলত শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর জন্যই এই প্রজ্ঞাপনগুলো জারি করা হয়। এই অব্যাহতির সুবিধা নিয়ে কোম্পানিটি শ্রমিকদের দৈনিক শ্রমঘন্টা ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১০ ঘন্টা এবং সাপ্তাহিক ছুটি দেড় দিনের পরিবর্তে ১ দিন নির্ধারণ করেছে। তামাক কোম্পানিকে এ ধরনের অব্যাহতি প্রদান এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩ গাইডলাইনের ৭.১ এর সাথে সাংঘর্ষিক, যেখানে তামাক কোম্পানিকে সকল অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা প্রদান করা থেকে সরকারকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

টেবিল ১: বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর কয়েকটি ধারার প্রয়োগ থেকে বিএটিবি-কে অব্যাহতি প্রদান করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপন এর বিবরণ
প্রজ্ঞাপন নং এবং প্রজ্ঞাপনের কপি প্রজ্ঞাপনের গেজেট প্রকাশের তারিখ অব্যাহতির মেয়াদ
40.00.0000.016.34.009.12-241 ৯ অক্টোবর, ২০১৭ ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ হইতে ২৪ মার্চ, ২০১৮ (০৬ মাস)
40.00.0000.016.34.009.12-108 ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ থেকে ২৪ মার্চ, ২০১৭ (০৬ মাস)
40.00.0000.016.34.009.12-56 ২৮ এপ্রিল, ২০১৬ ২৫ মার্চ, ২০১৬ হতে ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ (০৬ মাস)
40.00.0000.016.34.009.12-99 ২১ অক্টোবর, ২০১৫ ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ হইতে ২৪ মার্চ, ২০১৬ (৬ মাস)
40.00.0000.016.34.009.12-40 ২২ এপ্রিল, ২০১৪ ২৬ মার্চ, ২০১৪ হইতে ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ (০৬ মাস)

উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিএটির বিরুদ্ধে অর্থায়ন, অনুদান প্রদানের মাধ্যমে কোম্পানির ইমেজ বৃদ্ধি এবং কোথাও কোথাও ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসায়িক সুবিধা আদায়ের প্রমাণ মিলেছে। এমনকি, বিএটি কর্তৃক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’কে অর্থায়নের প্রমাণও পাওয়া গেছে। তামাকচাষে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে পূর্ব আফ্রিকার মালাউয়িসহ কয়েকটি দেশে আইএলও এর তত্ত্বাবধায়নে ‘ইলিমিনেটিং চাইল্ড লেবার ইন টোব্যাকো গ্রোয়িং (ইসিএলটি) ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক পরিচালিত প্রকল্পে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অর্থায়ন করছে বিএটি। বিএটি’র ২০১৬ সালের সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টেও এর উল্লেখ রয়েছে। তবে তামাকবিরোধীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি আইএলও’র গভর্নিং বডির সভায় তামাক কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর আগে, ২০১৫ সালে বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে অবৈধ সুবিধা পেতে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ প্রদানের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পায়। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে আফ্রিকার বাজার দখলের লক্ষ্যে ঐ অঞ্চলের কমপক্ষে ৮টি দেশের সরকারকে জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত রাখতে বিএটি কর্তৃক হুমকি প্রদান, জবরদস্তি এমনকি মামলা করার তথ্য উঠে এসেছে। এসব দেশগুলো হচ্ছে কেনিয়া, উগান্ডা, নামিবিয়া, টোগো, গ্যাবন, কঙ্গো, ইথিওপিয়া ও বুরকিনা ফাসো।

এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ লঙ্ঘন করে তামাক কোম্পানিকে সুবিধা প্রদান এবং একইসাথে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ সরকারের দ্বৈত অবস্থানকে নির্দেশ করে। সুতরাং এফসিটিসি’র আর্টিকেল ৫.৩ গাইডলাইনের আলোকে বাংলাদেশে নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। অতিসত্ত্বর এই দাবি পূরণ করা গেলেই তামাক কোম্পানির আগ্রাসন থেকে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষা করা সম্ভব হবে।

Source: Tobacco Industry Watch BD Team@PROGGA

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org