বাস্তবায়নে বড় বাধা তামাক কোম্পানি

নানা কৌশলে চলছে তামাক পণ্যের প্রচারণা
আসন্ন বাজেটে সুবিধা পেতে চলছে লবিং


ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-কে প্রভাবিত করছে দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানিগুলো। আর এ জন্য নানামুখী কৌশলও অবলম্বন করছে তারা। যেমন- অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং অর্থায়ন, বিভ্রান্তিমূলক ফ্রন্ট গ্রুপ তৈরি, এনজিও এবং উন্নয়ন অ্যাডভোকেসিতে জড়িতদের অর্থায়ন, গবেষণায় সহায়তা, কৌশলী প্রচারণা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি অন্যতম। আসন্ন বাজেটকে প্রভাবিত করতে ইতোমধ্যেই জোরেশোরে লবিং শুরু করেছে তামাক কোম্পানিগুলো।
তামাক কোম্পানির নানামুখী কূটকৌশল দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি 'ফ্রেসওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিসিটি) বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন তামাকবিরোধী আন্দোলনের নেতারা। তাদের অভিযোগ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিনটি কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল (পিএমআই), ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) ও জাপান টোব্যাকো (জেটি) সামগ্রিক তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকা-কে দুর্বল করতে এবং একই সঙ্গে তামাকের ব্যবহার সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা বলছেন, সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁৗছানো সম্ভব না।
তামাক কোম্পানিগুলোর কূটকৌশল :
বিজ্ঞাপণ, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়তই কূটকৌশল অবলম্বন করছে। বিক্রয়কেন্দ্রে সিগারেটের প্যাকেট ডিসপ্লের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের জন্য বিক্রেতাদের মাসিক চুক্তিতে টাকা দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সিগারেট বিক্রির বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে দোকান সাজিয়ে দেয়া, বিক্রেতাদের উপহার ও সুবিধা দেয়া, কোন কারণে ম্যাজিস্ট্রেট ফাইল করলে তা পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয়া, প্রচারণায় অনাগ্রহ দেখালে সিগারেট সরবরাহ বন্ধের হুমকি, ড্যাংলার দেখা না গেলেও নতুন নতুন কৌশলে বিজ্ঞাপণ চালাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। এ ক্ষেত্রে ডারবি-মার্লবোরো-জাভা বস্নাক-বেনসন সিগারেটের বিজ্ঞাপণ বেশি হচ্ছে। সিগারেটের প্যাকেটের আদলে দোকান সাজিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিযোগিতা ও কনসার্টের মাধ্যমে, চাকরি দেয়ার নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে তামাক পণ্যের প্রচারণা। এছাড়া সিএসআরের নামেও চালাচ্ছে কোম্পানির প্রচারণা কার্যক্রম। তামাক চাষিদের ভর্তুকি মূল্যের সার ও সেচ সুবিধাও দিচ্ছে তারা।
আসন্ন বাজেটে সুবিধা নিতে লবিং শুরু :
রাষ্ট্রীয় কর কাঠামোকে প্রভাবিত করে সুবিধাজনক কর অব্যাহতি পেতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। আগামী ১৫ এপ্রিল সকাল ১০টায় এনবিআর'র সভাকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এর আগে গত ২২ মার্চ বিএটিবির চেয়ারম্যানসহ তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আগামী ২০১৫-১৬ বাজেটে তামাকের বিদ্যমান কর কমানো, ধাপ পুনর্বিন্যাস ও বিদেশি সিগারেটের চোরাচালান বন্ধের দাবি জানান। প্রসঙ্গত, গত বছর এপ্রিলে ২০১৪-১৫ বাজেটের আগে কর কমানোসহ নানাবিধ সুবিধা আদায়ের জন্য অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা এনবিআর'র তৎকালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিল, যা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। এফসিটিসি'র আর্টিক্যাল ৫.৩ ভঙ্গ করে তামাক কোম্পানিগুলো যাতে এবারেও গোপন বৈঠক না করতে পারে সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে বলেছেন তামাকবিরোধী আন্দোলনের নেতারা।
আইনে যা আছে :
তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন ২০১৩-এর ৫ ধারাটিতে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধান নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে। সেখানে বলা আছে, প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে প্রলুব্ধকরণের উদ্দেশ্যে, এর কোন নমুনা, বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে, জনসাধারণকে প্রদান বা প্রদান করার প্রস্তাব করা যাবে না। তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা এর ব্যবহার উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোন দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান বা কোন অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করা যাবে না। কোন প্রেক্ষাগৃহে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বা ওয়েব পেজে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার অনুরূপ বা সাদৃশ্য অন্য কোন দ্রব্য বা পণ্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার উৎপাদন, বিক্রি বা বিতরণ করতে পারবেন না। তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা লভ্য ও প্রচারিত, বিদেশে প্রস্তুতকৃত কোন সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্যচিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোন গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত দেয়া হয়েছে কোন সিনেমায় কাহিনীর প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক হলে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার দৃশ্য রয়েছে এমন কোন সিনেমা প্রদর্শনের সময় তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে লিখিত সতর্কবাণী, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পর্দায় প্রদর্শন করতে হবে।
সিএসআর সম্পর্কে আইনে যা বলা আছে : সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করলে বা উক্ত কর্মকা- বাবদ ব্যয়িত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে কোন তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। অথবা তা ব্যবহারে কোন ব্যক্তিতে উৎসাহ দেয়া যাবে না।
শাস্তির বিধান আছে আইনে : কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদ- বা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থ দ- বা উভয় দ-ে দ-নীয় হতে পারে এবং ওই একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা বারবার একই ধরনের অপরাধ করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে আগের দ-ের দ্বিগুণ হারে দ-নীয় হবেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য :
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা)'র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। তারা বাংলাদেশকে তামাক চাষের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। রংপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকায় তামাক চাষ কমলেও ওইসব অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোকে তামাক চাষের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। তারা নানা কৌশলে নিজেদের প্রচারের কাজ অব্যাহত রেখেছে। তামাকের চুলি্লতে প্রতিনিয়তই কাঠ ব্যবহার হচ্ছে। আর সিএসআরের অংশ হিসেবে কোম্পানিগুলো বনায়নের কাজ করছে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বন উজাড় হওয়ার ৩০ শতাংশই দায়ী তামাক। তামাক কোম্পানিকে নিষিদ্ধ নয়, তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আমাদের। কারণ তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করে চাষ নিষিদ্ধ করণের প্রক্রিয়াটি আমাদের জন্য বুমেরাং হবে।
এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা)'র আহ্বায়ক মো. রুহুল আমিন রুশদ বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। যার কারণে পাসকৃত বিধিমালা কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তবে ১২ মার্চ পাস হওয়া বিধিমালায় ভালো কিছু সিদ্ধান্তও রাখা হয়েছে। যেমন- দশটি জায়গায় 'স্মোকিং জোন' রাখা যাবে না। এর প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাখা হয়েছে। এছাড়া দায়িত্বরত এবং ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় কোন পুলিশ ধূমপান করতে পারবে না। বিধিমালা পাস হওয়ায় তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবার্তা দেয়া বাধ্যতামূলক হয়েছে। ছবিসহ সতর্কবার্তা যুক্ত হলে বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে সাজানোর বিষয়টিও কমবে।
দি ইন্টারন্যাশনাল এগেইনেস্ট টিভি অ্যান্ড লাং ডিজিজ (দি ইউনিয়ন)'র কারিগরিক পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, শুধু তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন নয় আইন না মানার সংস্কৃতি আমাদের দেশে সর্বত্রই। তামাক কোম্পানিগুলো সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে। জনগণকে আইন লঙ্ঘন করতে উৎসাহিত করছে।
তিনি বলেন, তামাক পণ্যের দাম বাড়লে এর ব্যবহার কমে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এটি প্রমাণিত। অথচ তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে তামাকের ওপর আরোপিত বিভিন্ন শুল্ক কমানোর চেষ্টা করে থাকে। সিগারেটের ওপর করের হার নির্ধারণে সিগারেট কোম্পানির হস্তক্ষেপ বাংলাদেশে নিয়মিতই ঘটছে। করারোপ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বিড়ি শিল্পের মালিকরাও। তামাকের ওপর কর বাড়লে তামাক পণ্যের চোরাচালন বাড়ে এমন প্রচারণা চালিয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষক করা তামাক কোম্পানিগুলোর অন্যতম একটি কূটকৌশল।
টোবাকো ফ্রি কিডস'র বাংলাদেশ প্রতিনিধি তাইফুর রহমান বলেন, তামাক কোম্পানির মতো এত বাণিজ্যিক স্বার্থ আর কোন কোম্পানিই বোধ হয় দেখে না। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো তামাক কোম্পানির ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যে সব পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার তামাক কোম্পানিগুলো তার সবগুলো পদ্ধতিই অবলম্বন করছে। তবে সরকারের উচিত জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা তামাক কোম্পানির স্বার্থ নয়। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে এই জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিই তামাক কোম্পানিগুলো উপেক্ষা করে যাচ্ছে। আর তামাকের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিরপেক্ষ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে জনস্বাস্থ্যের কথা।
তিনি বলেন, তামাক চাষি এখন আর চাষি নেই। তামাক কোম্পানিগুলোই এখন তামাক চাষির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর তামক চাষিরা পরিণত হয়েছে তাদের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকে। বিভিন্ন প্রলোভনে তারা চাষিদের গিলে খাচ্ছে। তামাক চাষে চাষিদের স্বাধীনতা দিলে এবং তামাক কোম্পানির সম্পৃক্ততা বন্ধ করতে পারলে তামাক চাষ তুলনামূলকভাবে কমে আসবে।

Source: sangbad,published:04-04-2015

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org