স্তরভিত্তিক কর রাজস্ব ফাঁকির হাতিয়ার

দেশে তামাকের করসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের উপর যথার্থ হারে কর আরোপিত হয়নি। এতে সস্তায় মিলছে তামাকজাত পণ্য। সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে শুধু মূল্যস্তর ও ভিত্তিমূল্য সমন্বয় করার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে সিগারেট-বিড়ির প্রকৃত মূল্য দিন দিন কমছে। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশে তামাক পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম। ফলে বাড়ছে তামাক সেবনকারীর সংখ্যা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র মতে, বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের উপর বিদ্যমান কর কাঠমো জটিল। এখানে তামাকের রাজনীতি জড়িত। জটিল কর কাটামোর কারণেই কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে এইচডিআরসি উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেন, সিগারেটের ক্ষেত্রে চার মূল্যস্তর ভিত্তিক কাঠামো, ভিন্ন ভিন্ন মূল্যস্তরের উপর ভিন্ন ভিন্ন হারে কর, ভ্যাট ও করারোপের ভিত্তি কর কাঠামোকে জটিল করে তুলেছে। এই জটিল কর কাঠামোর সুবিধা পাচ্ছে তামাক কোম্পানি আর বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। তামাক পন্যের উপর অধিকহারে কর বাড়ানোর বিকল্প কিছু নেই। তাছাড়া সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর তুলে দিতে হবে। কেননা এক ধাপের সিগারেটের দাম বাড়লে মানুষ অন্যটিতে যেতে পারে। যখন সব রকম তামাক পন্যের দাম বাড়বে তখন এর ব্যবহার কমে আসবে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী ইতিপূর্বে বলেন, আগে আমরা টোব্যাকো কোম্পানির সঙ্গে বসে আলাপ আলোচনা করে একটা সমঝোতার মাধ্যমে কর ঠিক করতাম। আমরা বিভিন্ন স্তর করে দিতাম যে, এটা এমন হবে, এই স্তরে অত শুল্ক হবে। এবার আর আমরা এমনটা করব না। এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেব। অন্যান্য দেশে যেভাবে তামাকের ওপর কর ধার্য করা হয়, আমরাও সেভাবে করব।
প্রজ্ঞা ও এইচডিআরসি’র পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যে বাজেট প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, প্রচলিত বিভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেটের মূল্যভিত্তিক স্তর ও তার উপর করারোপের বর্তমান পদ্ধতি বিলোপ করা প্রয়োজন। আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এখনকার চারটি মূল্যস্তরের পরিবর্তে তিনটি মূল্যস্তর থাকবে যেখানে বর্তমানের নি¤œ মূল্যস্তর থাকবে না। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিনটি মূল্যস্তরে (কম মূল্য থেকে বেশি মূল্য) প্রতি ১০ শলাকার উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ (স্পেসিফিক) এক্সাইজ ট্যাক্স (যথাক্রমে ৪০, ৬০, এবং ১০০ টাকার সমপরিমাণ) আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ মূল্যস্তরকে ২ মূল্যস্তরে রূপান্তরিত করা এবং প্রতি ১০ শলাকার উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ (স্পেসিফিক) এক্সাইজ ট্যাক্স যথাক্রমে ৬৬ টাকা এবং ১১০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে মূল্যস্তর হবে একটি (ভিন্ন ভিন্ন মূল্যস্তর থাকবে না) এবং সব ধরনের সিগারেটের উপর অভিন্ন এক্সাইজ ট্যাক্স প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের উপর ১২১ টাকা আরোপ করা হবে।
তামাকের কর সংক্রান্ত এক বিশ্লেষনে দেখা যায়, তামাক পণ্যের উপর ৭০ শতাংশ সম্পুরক শূল্ক ধার্য করা হলে এক বছরে বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৬০ কোটি সিগারেট-বিড়ির শলাকা ব্যবহার কমবে এবং তামাক খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব অর্জিত হবে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা।
২০০৪ সালে তামাক পণ্যের ব্যবহার ছিল ৩৭ শতাংশ ২০০৯ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাড়ছে উৎপাদন। সিগারেটের উৎপাদন ১৯৯৪ সালে ছিল ১ হাজার ৬শ শলাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬শ শলাকায়। অর্থাৎ ১৬ বছরে উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
তামাক পণ্যের দাম বাড়লে যে এর ব্যবহার কমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এটি প্রমানিত। ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখা গেছে বাংলাদেশে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য যখনই বেড়েছে, তখনই এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষনায় দেখা গেছে, তামাকজাত দ্রব্যের ১০ শতাংশ (প্রকৃত) মূল্যবৃদ্ধি হলে এর ব্যবহার উন্নত দেশে ৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৮ শতাংশ কমে আসে।
২০১২ সালে প্রকাশিত দ্য ইকনোমিকস অব টোব্যাকো অ্যান্ড টোব্যাকো ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে বাংলাদেশেই সিগারেটের দাম সবচেয়ে কম। বিড়ির দাম আরও কম। বলা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে সিগারেটের প্রকৃত মূল্য অর্থাৎ অন্যান্য পণ্যের মূল্যের তুলনায় ক্রমাগত কমছে। অন্যদিকে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে এবং এভাবে তামাক পণ্য ক্রমশ: আরো বেশি পরিমানে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসছে। তাছাড়া তামাক পণ্যের জটিল কর কাঠামোর কারনে কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করছে তামাক কোম্পানিগুলোকে। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
এক্ষেত্রে বলা হয়েছে সিগারেটের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর ভিত্তিক কর কাঠামো, ভিন্ন ভিন্ন মূল্যস্তরের উপর ভিন্ন ভিন্ন হারে শতাংশ হিসেবে (এড ভ্যালোরেম) কর, ভ্যাট ও করারোরেপে জটিল ভিত্তি এসব তামাক পণ্যের কর কাঠামোকে জটিল করে তুলেছে। বিড়ির উপর ধার্যকৃত কর অত্যন্ত কম এবং তা কেবল সরকার-নিদিষ্ট ট্যারিফভ্যালুর উপর প্রযোজ্য। তামাক পণ্যের এ জটিল কর কাঠামোর সুবিধা পাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো এবং সরকার এ খাত থেকে সম্ভাব্য রাজস্ব আয় করতে পারছে না।
ওই গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, তামাকের ব্যবহার কমানোর সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে তামাকজাত পণ্যের উপর এমনভাবে কর বাড়ানো যাতে এসব দ্রব্যের মূল্য নিশ্চিতভাবে বাড়ে। সিগারেটের অতিরিক্ত মূল্য তরুনদের ধূমপান করা থেকে বিরত রাখবে এবং বর্তমান ধূমপায়ীদের সিগারেট সেবন ছেড়ে দিতে ভূমিকা রাখবে। বলা হয়েছে বাংলাদেশে বিদ্যমান মূল্যস্তর ভিত্তিক কর কাঠামোর পরিবর্তে সব ধরনের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের উপর ৩৪ টাকা হারে একক (স্পেসিফিক ট্যাক্স) আরোপ করা হলে সিগারেটের উপর একসাইজ ট্যাক্সের (সম্পূরক শুল্কর) পরিমাণ হবে গড়পরতা খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ। আর বিড়ির ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ শলাকার প্যাকেটের খুচরা মূল্যের উপর ৪ দশমিক ৯৫ টাকা হারে কর আরোপ করা হলেও এক্সাইজ ট্যাক্সের পরিমান হবে গড়পড়তা খুচরা মূল্যের ৭০ শতাংশ। এর ফলে প্রায় ৭০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী সিগারেট সেবন ছেড়ে দেবেন। ৭১ লাখ তরুণ ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত হবে। প্রায় ৬০ লাখ অকাল মূত্যর রোধ করা যাবে এবং সরকার ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করবে। এছাড়া বিড়ির ক্ষেত্রে প্রায় ৩৪ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক বিড়ি ধূমপায়ী বিড়ি সেবন ছেড়ে দেবেন। প্রায় ৩৫ লাখ তরুন নতুন করে বিড়ি সেবন শুরু করবে না। প্রায় ২৪ লাখ অকাল মৃত্যু রোধ করা যাবে এবং বিড়ি থেকে সরকার বাড়তি ৭২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে। সিগারেট এবং বিড়ি থেকে যে বাড়তি ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে তা দিয়ে ১২ হাজার ৩৩৩টি বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।

Source: Dainik amadershomoy,22 May,2015

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org