‘জনস্বার্থে’ ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বাড়াতে প্রজ্ঞাপন

দেশের বর্তমান শ্রম আইনে কোনও প্রতিষ্ঠান ছুটির দিন বাদে একজন শ্রমিককে দিয়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করাতে পারবে। কিন্তু ‘জনস্বার্থে’ প্রজ্ঞাপন জারি করে বহুজাতিক তামাক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকোর (বিএটি) জন্য ওই আইনকে শিথিল করা হয়েছে। এই ঘটনাটিকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এমন শ্রমিকস্বার্থবিরোধী সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে।
শ্রম আইনের ১০২ ধারা অনুযায়ী, একজন শ্রমিকের জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা আছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, ওই ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে বিশেষ সুবিধা নিতে শ্রমিকদের দৈনিক শ্রমঘণ্টা ৮ ঘণ্টার বদলে ১০ ঘণ্টা করে নিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো (বিএটি)। এর ফলে কোম্পানিটি তাদের শ্রমিকদের সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতে বাধ্য করতে পারবে। বিএটি-কে এই সুযোগ দিয়ে সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এর ফলে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে একজন শ্রমিক যে বেতন পেতেন, এখন ৬০ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও একই সমান বেতন জুটবে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ধারা ১০০, ১০২, ১০৪, ১০৫ ও ১১৪ (১)-এর বিধানের প্রয়োগ থেকে শর্ত সাপেক্ষে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো (বিএটি) কোম্পানিকে অব্যাহতি দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। ‘জনস্বার্থে’ এই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে শ্রম মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, শ্রম আইনের ১০২ ধারা অনুযায়ী, সপ্তাহে ৪৮ কর্মঘণ্টা নির্ধারিত থাকলেও এই প্রজ্ঞাপন বলে বিএটি শ্রমিকদেরকে ৪৮ ঘণ্টার পারিশ্রমিক দিয়ে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতে বাধ্য করতে পারবে। এছাড়া আইনের ১০৪ ধারা অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণমূলক সাপ্তাহিক ছুটি (অর্থাৎ কোনও শ্রমিক তার প্রাপ্য ছুটি থেকে বঞ্চিত হলে ওই ছুটির সমসংখ্যক ছুটি) দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং ১১৪ (১) ধারার (শিল্প প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দেড় দিন বন্ধ রাখার বিধান) প্রতিপালন থেকেও বিএটি-কে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে কোম্পানিটি প্রত্যেক শ্রমিককে পর্যায়ক্রমে সপ্তাহে একদিন ছুটি দেবে।

আবার আইনের ১০৫ ধারা অনুযায়ী, একজন শ্রমিকের কর্মসময়ে অতিরিক্ত কাজ, খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের ১ ঘণ্টা বিরতিসহ দৈনিক সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টার বেশি না হওয়ার বিধানের প্রয়োগ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বেচ্ছায় আগ্রহী শ্রমিকদের দ্বিগুণ মজুরি দেওয়া সাপেক্ষে অতিরিক্ত সময় কাজে নিয়োগ করা যাবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ধারা ৩২৪ এর উপ-ধারা (১) ও উপ-ধারা (২) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শ্রম মন্ত্রণালয় ৬ মাসের (২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে ১৭ মার্চ ২০১৭) জন্য কোম্পানিটিকে এই অব্যাহতি দিয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনের ১ নং শর্তে বলা হয়েছে, ‘কোনও শ্রমিককে দিয়ে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না।’ অর্থাৎ আগে সপ্তাহে যেখানে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে ৪৮ ঘণ্টার শ্রম পেতো কোম্পানি, সেখানে এই প্রজ্ঞাপনের বলে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে ৬০ ঘণ্টা, অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা বেশি শ্রম পাবে। ৪৮ ঘণ্টার পারিশ্রমিক দিয়ে ৬০ ঘণ্টা কাজ করানো যাবে। এর বেশি সময় কাজ করালে তা ওভার টাইম হিসেবে গণ্য হবে বলে সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
জানা গেছে, অব্যাহতি দেওয়ার এই সময়টা মূলত তামাক চাষ ও তামাক পাতা ক্রয়-বিক্রয়ের মৌসুম। শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর জন্যই বিএটি এই অব্যাহতি আদায় করে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে জনস্বার্থ কীভাবে জড়িত আছে, তা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তামাকবিরোধী সংগঠন ‘প্রজ্ঞা’ (প্রগতির জন্য জ্ঞান)-এর নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘তামাক শুধু মানবদেহই নয়, সার্বিক পরিবেশের জন্য একটি ক্ষতিকর পণ্য। তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের ব্যাপক কর্মসূচি রয়েছে। তামাকের ফলে পরিবেশ ও মানব দেহের ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থও ব্যয় হচ্ছে। তামাক ব্যবহারকারী এবং উৎপাদনকারী কৃষকসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই যেখানে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে, সেক্ষেত্রে একটি সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিকে কীভাবে জনস্বার্থে কাজ করছে বলে শ্রম মন্ত্রণালয় এই বাড়তি সুবিধা দিলো, সে বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শ্রমিকদের সম্মতিতেই ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো (বিএটি)-কে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখানে শ্রম আইন লঙ্ঘিত হয়নি। শুধু বিএটি-ই নয়, প্রাণসহ আরও কয়েকটি কোম্পানিকে এ সুবিধা দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকরা বাড়তি সময়ের ওভার টাইম পাবেন। তবে কোনও শ্রমিক ওভার টাইম করতে না চাইলে কোম্পানি তাকে জোর করতে পারবে না।’
জানা গেছে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে বছর বছর মোটা অংকের টাকা অনুদান দেয় বিএটি। অভিযোগ উঠেছে, এর বিনিময়েই এই সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিটি। এছাড়া বর্তমান শ্রম সচিব মিকাইল শিপারকে চলতি বছরের মার্চ থেকে বিএটি-র ইনডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসবের সূত্র ধরেই কোম্পানিটি এমন শ্রমস্বার্থবিরোধী অব্যাহতি পেয়ে থাকতে পারে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তামাক কোম্পানিকে এভাবে লাভবান করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব নয় বলেও মনে করা হচ্ছে।
তবে এ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পদাধিকার বলেই শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব বিএটি-র ইনডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর। মিকাইল শিপার এই মন্ত্রণালয়ের সচিব না থাকলে তিনি ওই কোম্পানির পরিচালক থাকতে পারবেন না। তার স্থলে যিনি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়ে আসবেন, তিনিই ওই কোম্পানির পরিচালক হবেন। এ ক্ষেত্রে শ্রম সচিবের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও স্থান নেই।’

Source: Bangla tribune, 18 oct, 2016

About Tobacco Industry Watch

House 6 (3rd Floor, East Side), Main Road 3, Block A, Section 11, Mirpur, Dhaka-1216
Tel: +88-02-9005553, Fax : +88-02-8060751,
URL : www.tobaccoindustrywatchbd.org, Skype ID: progga.bd

Email: progga.bd@gmail.com, info@tobaccoindustrywatchbd.org