বিধিমালায় আটকে আছে তামাক পণ্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী
হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ আইন সংশোধনীর ২১ মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু বিধিমালা না হওয়ায় আটকে আছে তামাক পণ্যের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণীর বিষয়টি। এ প্রেক্ষাপটে বিধিমালা নিয়ে তামাক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আজ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এ বৈঠকে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ক্যাম্পেন ফর টোব্যাকো ফ্রিকিডসের কান্ট্রি ডাইরেক্টর তাইফুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা এ বিষয়ে তামাক কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক করার কিছু আছে বলে মনে করি না। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ছয় মাসের মধ্যে ছবিসহ সতর্কবাণী দিয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে এক বছরেরও কম সময় লেগেছে। সেখানে বাংলাদেশে কেন ছবিসহ সতর্কবাণী দিতে ১৮ মাস সময় চাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। বিধিমালায় প্রস্তাবিত ৯ মাসের মধ্যে কেন সম্ভব হবে না। এর অর্থই হচ্ছে কালক্ষেপণ করা। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনস্বার্থ রক্ষায় যে কটি আইনের সংশোধন হয়েছে, তার মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী তাৎপর্যপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। ২০০৫ সালের আইনটিতে দুর্বলতা থাকায় সংশোধনের দাবি উঠেছিল। দাবির যৌক্তিকতার কারণে ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০১৩’ জাতীয় সংসদে পাস হয়, যা ওই বছরের ২ মে গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে ওইদিন থেকেই কার্যকর হয়েছে।
কিন্তু বহু চেষ্টার পর ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে সিগারেটসহ তামাক জাতীয় পণ্যের প্যাকেট ও মোড়কে ৫০ শতাংশ জায়গায় ছবি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়, যা ছিল বড় পরিবর্তন। কারণ এরই মধ্যে প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ৬০টি দেশ ছবিযুক্ত মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। প্যাকেটের গায়ে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মুখের-হাতের ক্যান্সারসহ ক্ষতের ছবি দেখে অনেকেই আঁতকে উঠবেন। গবেষণায় প্রমাণিত, এতে অনেক ধূমপায়ী ধূমপান কমিয়ে দেন এবং আস্তে আস্তে ছেড়ে দেন। ফলে উন্নত দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ছবিযুক্ত প্যাকেটের কার্যকারিতা অনেক বেশি। শিক্ষার অভাবে অনেকেই ধূমপান মৃত্যুর কারণ, তা পড়তে পারেন না। ছবি থাকার কারণে এখন যে কেউ বুঝতে পারবেন সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহতা। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে আইন পাস করলেও ভেটিংয়ের নামে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে আইন মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। কমিটির প্রস্তাবে বিধি কার্যকরের নয় মাসের মধ্যে ছবিযুক্ত প্যাকেট বাজারজাতকরণের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। তামাক নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে ছয় মাস। অর্থাৎ পুরনো প্যাকেটে বিড়ি-সিগারেটসহ তামাক জাতীয় পণ্য বিক্রি নয় মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে, যা অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু অতি আগ্রহী আইন মন্ত্রণালয় তা ১৮ মাস পর করার সুপারিশ করেছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ধূমপান ছাড়াও জর্দা, গুল, খৈনি ও সাদাপাতা অর্থাৎ ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যের প্রসার বেড়ে চলছে। এতে ক্যান্সারসহ আটটি রোগে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে দেশের সিংহভাগ মানুষ। ২০০৯ সালের হিসাবেই বছরে তামাকজনিত কারণে ৫৭ হাজার মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে, পঙ্গু হওয়াসহ প্রায় ১২ লাখ মানুষ তামাকের বিষে অসুস্থ হচ্ছে। এতে উপার্জনক্ষম মানুষ হারিয়ে পরিবারগুলো যেমন পথে বসছে, তেমনি সরকারের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ছে, যা তামাক থেকে পাওয়া রাজস্বের তুলনায় অনেক বেশি।
কিন্তু তারপরও ধূমপানসহ তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতি থেকে যুবসমাজকে রক্ষায় এ আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বিধিমালার অভাবে। আইন পাসের পর তা বাস্তবায়নে খুঁটিনাটি দিকগুলো নির্ধারণ হয় বিধির মাধ্যমে। নিয়মমাফিক বিধি প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটি বিধিমালা চূড়ান্ত করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা পাঠিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য। কিন্তু প্রায় ২১ মাস গড়িয়ে এলেও আইন মন্ত্রণালয় অন্য কোন আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ভেটিং শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার, দায়িত্ব শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার হলেও রহস্যজনকভাবে আইন মন্ত্রণালয় বিধির বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনে ফেরত পাঠিয়েছে এবং এমন সব পরিবর্তন, যা সংশোধিত তামাক আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করবে বলে মনে করছেন তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা সহকারে পাল্টা জবাবও দেয়। বিধি নিয়ে চলছে মন্ত্রণালয় দুটির মধ্যে রশি টানাটানি। বিধিমালা শীঘ্রই সহসা চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে আইন থাকলেও তার কার্যকর প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।
আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংশোধনীগুলোর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভেটিংয়ের দেরির কারণ ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। যেমন আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে ‘কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ হিসেবে সিনিয়র স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মকর্তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। একইভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের বদলে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার সুপারিশ করা হয়। সাধারণভাবে বোঝা যায়, জনসচেতনতা সৃষ্টিতে স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মকর্তা ও স্যানিটারি কর্মকর্তার গুরুত্ব উপজেলা পর্যায়ে অনেক। ধূমপান নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ আইন প্রয়োগের জন্য তাদের পাওয়াটাও সহজ। কিন্তু সব উপজেলায় সব সময় প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাকে এসব কাজে পাওয়া যায় না। নিজ নিজ দফতরের কাজে ব্যস্ত থাকা কর্মকর্তারা বাড়তি এ কাজেও আগ্রহ কম দেখান।
সূত্র জানায়, বিড়ি-সিগারেটের নেশায় অভ্যস্ত হলে তা চলে আমৃত্যু। তাই কম বয়সে তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোম্পানিগুলো। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের উপহারের প্রলোভন দেখায়। সংশোধিত আইনের বিধিতে তাই পাবলিক প্লেস হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধূমপানমুক্ত রাখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু উল্টো পথে হাঁটতে চায় আইন মন্ত্রণালয়।
Source:daily janakantha,15/01/2015