প্রথম আলো-প্রজ্ঞা গোলটেবিল বৈঠক :তামাক উৎপাদন ও বিপণন দুই–ই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
প্রথম আলো-প্রজ্ঞা আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ধূমপানমুক্ত পরিবেশের জন্য তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন আলোচকেরা। গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ওই বৈঠকে তাঁরা বলেন, তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আইন মানছে না।
আসাদুজ্জামান খান কামাল‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও ধূমপানমুক্ত পরিবেশ’ শিরোনামে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শুধু আইন দিয়ে ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের আগাম টাকাপয়সা দিচ্ছে তামাক চাষের জন্য। তামাক চাষে যে জমির উর্বরতা কমছে, সে বিষয়ে কৃষকদের ও ধূমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, মানুষের উপকারে আসে এমন যেকোনো কিছু নিজস্ব উদ্যোগে প্রথম আলো সব সময় প্রকাশ করে থাকে। তিনি বলেন, তামাক ও মাদকবিরোধী তথ্য বা সচেতনতা সৃষ্টিমূলক বিজ্ঞাপন বিনা মূল্যে প্রথম আলোয় প্রকাশ করা হয়, ভবিষ্যতেও হবে।
সাংসদ ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে তামাকের চাষ হতো ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে। গত অর্থবছরে জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮ হাজার হেক্টরে। তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে তামাক উৎপাদনের জমিতে সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া বা সারের প্যাকেটের গায়ে ‘এটি তামাক উৎপাদনের জন্য নয়’ এমন কথা লিখে দেওয়া যেতে পারে। সাংসদ কীভাবে তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৌশলে নিজেদের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে, তার ছবি দেখান।
গোলটেবিল বৈঠকে ধূমপানবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আলোচকেরা বলেন, তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় বলে তারা সরকারকে অনেক কর দেয়। কিন্তু ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি এবং তাতে সরকারের যে ব্যয়, তা তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া করের ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি। তাঁরা বলেন, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৫-কে যুগোপযোগী করে ২০১৩ সালে আইন সংশোধন করা হয়। কিন্তু বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় গত ১২ মার্চ। ধূমপানবিরোধী সংগঠনগুলোর দাবি, তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিধিমালা করার ক্ষেত্রে বাধা দিয়ে আসছিল বলেই এতটা সময় লেগেছে।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, তামাকজাত পণ্য বিপণনকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আইন মানছে না। যেসব দোকানে সিগারেট বিক্রি হয়, সেসব দোকান সাজিয়ে দেওয়া ও নিজেদের পণ্য যেন ক্রেতাদের চোখে পড়ে, সে উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন কৌশল অনুসরণ করে। যখন ভ্রাম্যমাণ আদালত যান তখন তারা বিভিন্ন ‘হ্যান্ড আউট’ দেখায়, প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে এটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজ নয়। কিন্তু তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে তারা (তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান’) আইন মানতে বাধ্য।
আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ধূমপানের ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে ১৯১৯ সালে জুভেনাইল স্মোকিং অ্যাক্ট করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পরও ধূমপান নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা যায়নি। তিনি কার্যকর প্রচারের মাধ্যমে যেভাবে ডায়রিয়ার মতো রোগ নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, সেই একই পদ্ধতিতে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ধূমপান রোধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রিয়াজ রহমান রাশিয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে রেস্তোরাঁয় অধূমপায়ীরা বসে খেতে পারেন, কিন্তু ধূমপায়ীদের রেস্তোরাঁর বাইরে কোনায় দাঁড়িয়ে খেতে হয়। এ ছাড়া উচ্চমাত্রায় ট্যাক্স বসিয়ে অনেক দেশে ধূমপানের পরিমাণ কমানো গেছে বলে তিনি জানান।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, একটা সময় গল্প, উপন্যাস, সিনেমা-নাটকে ধূমপানকে মহিমান্বিত করা হতো। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। তবু এখনো কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেলে কোনো কোনো চরিত্রের হাতে সিগারেট দেখা যাচ্ছে। সিগারেট ছাড়াও চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন সম্ভব। আলোচকেরা ধূমপান নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যমগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আইন প্রয়োগকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার বলে মন্তব্য করেন এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল টোব্যাকো কন্ট্রোল সেলের সাবেক সমন্বয়ক আমিন উল আহসান বলেন, সংশোধিত আইন ও বিধিমালায় টেলিভিশনসহ সব প্রচারমাধ্যমে ধূমপানের ছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় হলে কীভাবে তা দেখানো যাবে, সে সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, টেলিভিশনে, নাটকে বা সিনেমায় হতাশাগ্রস্ত কোনো চরিত্রকে যখন কেউ সিগারেট ধরাতে দেখে, তখন সে ধরে নেয়, হতাশা কাটাতে সিগারেট খাওয়াটা যৌক্তিক। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কিশোরী বা তরুণীদের মধ্যে ধূমপান করার পরিমাণ বেড়েছে। তাদের বোঝাতে হবে, ধূমপান মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। এ ছাড়া মেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলে, বয়সের আগেই বুড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে।
একই ইনস্টিটিউটের অপর সহকারী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন, ধূমপানের কারণে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরোক্ষ ধূমপানের শিকার শিশুর মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়, শিশুর মধ্যে অতি চঞ্চলতা ও অবাধ্যতা সমস্যার সৃষ্টি হয়। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিদের যে ফাউন্ডেশন কোর্স সেই, পাঠ্যক্রমে আইনটি যুক্ত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
Source:prothom-alo,এপ্রিল ১৯, ২০১৫