ছয় বছরে দ্বিগুণ জমিতে চাষাবাদ ॥ তামাক চাষে ১৫ জেলায় নীরব আগ্রাসন
লাভজনক বিবেচনায় ঝুঁকছেন চাষীরা
উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ
বছরে ৯৭ হাজার হেক্টর জমি চলে যাচ্ছে অকৃষিতে
দেশে নীরবে চলছে তামাক চাষের আগ্রাসন। গত ছয় বছরে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ। মাঝারি মানের জমিতেও তামাকের ভাল ফলন হয় না। এজন্য সবচেয়ে উর্বর ফসলী জমি ব্যবহৃত হচ্ছে তামাক চাষে। তাই এই ছয় বছরে তামাকের উৎপাদন বেড়েছে আড়াই গুণ। দীর্ঘমেয়াদে তামাক চাষে মাটির উর্বরতা ব্যাপক মাত্রায় কমে যায়। এতে জমি অন্যান্য ফসল চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তবুও সাময়িক আর্থিক লাভ বিবেচনায় ক্ষতিকর এ পণ্য চাষের প্রতি ঝুঁকছেন দেশের ১৫ জেলার প্রান্তিক কৃষকরা। জানা গেছে, একদিকে ধান, গম, আখ, আলু, পাটসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য বিক্রিতে ফড়িয়া, আড়তদারদের দৌরাত্ম্য, ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অনিশ্চয়তা এবং অপরদিকে কম সময়ে ঝামেলাহীন তামাক চাষ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা ও বিভিন্ন তামাক কোম্পানির লাভজনক প্রস্তাব এসব জেলার প্রান্তিক কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে।
তামাক রফতানিতে আয় বাড়ায় সরকারও এর ব্যাপকতা রুখতে করণীয় ঠিক করতে পারছে না। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০০৫-’০৬ অর্থবছরে তামাক থেকে মোট রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭০ লাখ ডলার, ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে এই আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। অথচ আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তামাকের চাহিদা হ্রাস ও যোগান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণে অঙ্গীকার করেছে। এ সংক্রান্ত একটি আইনও রয়েছে। তবে তা প্রয়োগে বিধিমালা নেই। এছাড়া কৃষকদের অসচেতনতা, তামাক কোম্পানির পুঁজির আগ্রাসনসহ নানা কারণে বেড়েই চলেছে তামাক চাষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর জেলার কৃষকরাই তামাক চাষে বেশি আগ্রহী। তাই তামাক চাষ বন্ধে বিদ্যমান আইন কার্যকরের পাশাপাশি ওই সব জেলায় বিকল্প কর্মসংস্থান চালু, পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে বিনিয়োগ, তামাক কোম্পানির কার্যক্রম নিবিড় মনিটরিংয়ের আওতায় আনা এবং তামাক চাষের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করতে হবে।
তামাক চাষে ব্যবহৃত জমি ও উৎপাদনের চিত্র ॥ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-’০৮ অর্থবছরে দেশে তামাকের চাষ হয় মোট ২৯ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে। সে বছর তামাকের উৎপাদন ছিল ৪০ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৫৫ হাজার ২৯০ হেক্টর; উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ছয় বছরে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে দ্বিগুণ ও আড়াই গুণ। এর মাঝের সময়ে প্রতি অর্থবছরেই তামাক চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে, সেই সঙ্গে বেড়েছে এর উৎপাদন। ২০০৮-’০৯ অর্থবছের তামাক চাষ হয়েছে ২৯ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে; উৎপাদন হয়েছে ৪০ হাজার ২৭০ মেট্রিক টন। ২০০৯-’১০ অর্থবছরে চাষ হয়েছে ৩৮ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে; উৎপাদন হয়েছে ৫৫ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন। ২০১০-’১১ অর্থবছরে চাষ হয়েছে ৪৮ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে; উৎপাদন হয়েছে ৭৯ হাজার ২৩০ মেট্রিক টন। ২০১১-’১২ অর্থবছরে চাষ হয়েছে ৫০ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন ৮৫ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন। তবে সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ (৫১ হাজারর ৯২৬ হেক্টর) আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমলেও খোদ অধিদফতরের কর্মকর্তারাই বলেছেন বাস্তব চিত্র ভিন্ন। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের তিরস্কারের ভয়সহ নানা কারণে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ কম দেখিয়ে থাকেন বলে তারা জানিয়েছেন। ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে তামাক উৎপাদনের হিসাব এখনও রেকর্ড করা হয়নি।
তামাক চাষের আগ্রাসনের শিকার ১৫ জেলা ॥ যে ১৫ জেলায় তামাকের চাষ বেড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলক অনগ্রসর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৩-’১৪ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি তামাকের চাষ হয়েছে কুষ্টিয়ায় ৩৯% (২০ হাজার ১৫০ হেক্টর)। দি¦তীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে লালমনিরহাট ২২% (১১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর) ও নীলফামারী ৯% (৪ হাজার ৪৫৫ হেক্টর)। এর পরে যথাক্রমে আছে বান্দরবান ৭% (৩ হাজার ৮১২ হেক্টর), মেহেরপুর ৭% (৩ হাজার ৪২৫ হেক্টর), রংপুর ৫% (২ হাজার ৫২২ হেক্টর)। এছাড়া মানিকগঞ্জ (১ হাজার ৯০০ হেক্টর), ঝিনাইদহ (১ হাজার ৩৭০ হেক্টর), কক্সবাজার (৮৫০ হেক্টর), চুয়াডাঙ্গা (৭০৫ হেক্টর), খাগড়াছড়ি (৬৮০ হেক্টর), টাঙ্গাইল (৩৩৭ হেক্টর), রাঙ্গামাটি (২৬৫ হেক্টর), চট্টগ্রাম (৬৩ হেক্টর) ও দিনাজপুরেও (৭ হেক্টর) তামাকের চাষ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ (২০১২-২০১৩) অনুযায়ী দেশে নিট ফসলী জমির মোট পরিমাণ ৭৯ লাখ ৮ হাজার ৭৭১ হেক্টর। আর খাদ্য মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের ফুড এ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) গবেষণা (২০১৩ সাল) মতে প্রতিবছর ৬৯ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী (২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত) এই সংখ্যা প্রতিবছর গড়ে ৯৭ হাজার হেক্টর। সংস্থাটির মতে এই সময়ে তামাক চাষ, চিংড়ি চাষ ও ইটভাঁটি নির্মাণে প্রতিবছর গড়ে ১৭ হাজার হেক্টর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিশাকান্দি ইউনিয়নের বড় গাংদিয়া গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন (৫০) জনকণ্ঠকে জানান, একটি তামাক কোম্পানির এজেন্টের পরামর্শে চলতি বছর তিনি প্রায় ৮ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছেন। ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে তামাক পাতা বিক্রি করে প্রায় ৭০ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। গত বছর একই জমিতে ধান চাষ করেছিলেন আফজাল। কিন্তু বাজারে ধানের দর কম থাকায় তার ৬ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিল। শুধু আফজাল হোসেন নন, তার মতো আরও অনেকেই লাভজনক বিবেচনায় ঝুঁকছেন তামাক চাষে। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কুলগাঁও গ্রামের কৃষক শামসুল ইসলাম (৫৬) বলেন, ‘ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যে ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। তামাক চাষে জমির উর্বরতা নষ্ট হয় জেনেও টাকার কথা ভেবে এ বছর ১২ বিঘা জমিতে তামাকের চাষ করেছি। গত বছর করেছিলাম এক বিঘাতে।’
দীর্ঘমেয়াদে তামাক চাষে জমি তার উর্বরতা হারায় জানিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. এম এ সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘তামাক চাষে প্রচুর রাসায়নিক সার লাগে। এতে মাটির বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া তামাক গাছের শিকড়ে এক ধরনের পরগাছা (ক্লোরোফিলবিহীন) জন্মায় যা মাটির উর্বরতা শুষে নেয়। তাই একটা সময়ে জমিতে তামাকের ফলন যেমন কমে যায়, তেমনি অন্যান্য ফসলও তেমন ফলে না।’
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অর্থকরী ফসলের তালিকায় তামাকের নাম থাকলেও তারা বলছে, নীতিগতভাবে সংশ্লিষ্ট তামাক চাষীদের দেয়া হয় না কোন রকমের সেচ, সার কিংবা কীটনাশক সুবিধা। আইনত বৈধ হওয়ায় কৃষি কর্মকর্তারা কোন চাষীকে তামাক চাষে বাধাও দিতে পারেন না। অধিদফতরের অর্থকরী ফসল উইংয়ের উপ-পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘জমিতে যে কোন বৈধ শস্য চাষের স্বাধীনতা কৃষকের রয়েছে। কৃষককে যদি ধান, চাল, গম, আখ ও পাটের মতো কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়া যেত, তবে তারা হয়ত তামাক চাষের প্রতি ঝুঁকতেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তামাক চাষীদের সচেতন করার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য হাইব্রিড কৃষিপণ্যের চাষের প্রতি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছেন।’
রংপুর-২ (বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ) আসনের সাংসদ আবুল কালাম আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও তামাক চাষে রংপুর শীর্ষস্থানীয় ছিল। আধুনিক কৃষির অপ্রচলন, বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা ও শিল্প কারখানা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমান সরকার রংপুরকে বিভাগ ঘোষণা দেয়ায় অবস্থা পাল্টেছে। বর্তমানে কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগের কারণে পুরো জেলায় তামাক চাষ আগের তুলনায় কমছে।’
Source: dailyjanakantha,৩ জানুয়ারী ২০১৫