বান্দরবানে বিষবৃক্ষ তামাকের আগ্রাসন
বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে বিষবৃক্ষ তামাকের চাষ। এক সময় ধান, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদের জন্য সুনাম ছিল এই জেলার। কিন্তু এখন মাঠের পর মাঠ জুড়ে শুধু তামাকের ক্ষেত। বিকল্প না থাকায় এই বিষবৃক্ষ চাষেই ঝুঁকে পড়ছেন চাষিরা।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি জমিতে তামাক নির্মূল অভিযান পরিচালনা করা হলেও দুই-তিন বছর ধরে তা স্তিমিত রয়েছে। এ কারণে বেড়ে চলেছে তামাক চাষ।
উৎপাদিত তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে তন্দুর (চুল্লি)। এসব চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনের কাঠ। স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ মন কাঠ ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে বান্দরবান বৃক্ষশুন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি হেক্টর জমিতে সাধারণত ৭০ বেল (এক বেল সমান ৪০ কেজি) তামাক পাতা উৎপাদন হয়। চলতি বছরে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হতে পারে ১৭ লাখ ৫০ হাজার বেল পাতা।
উৎপাদিত পাতা পোড়ানো হয় তন্দুল নামে পরিচিত চুল্লিতে। আর প্রতি ৭০ বেল তামাক পোড়াতে প্রয়োজন হয় চার টন জ্বালানি। প্রতি বছর তামাক পোড়াতে ব্যবহার হচ্ছে ১ লাখ টন বন থেকে সংগৃহীত জ্বালানি কাঠ।
যদিও বান্দরবান জজ আদালত ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর তামাক চাষের ওপর সুনির্দিষ্ট আদেশ প্রদান করে বলেন, ‘বান্দরবানে ১ হাজার হেক্টর ভূমিতে তামাক চাষ করা যাবে।’ জেলা জজ মো. কাউসার এই নির্দেশ প্রদান করে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু সূত্র মতে, জেলায় তামাক চাষ হচ্ছে ২৫ হাজার হেক্টর ভূমিতে।
ফসলি জমি ছাড়াও তামাকের আগ্রাসন থেকে বাদ পড়েনি স্কুলের মাঠ, লামা থানার ভূমি, বমু সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও মাতামুহুরী নদীর চর। উপজেলা পরিষদ, লামা থানা, আনসার ভিডিপি কার্যালয় থেকে ভূমি ইজারা গ্রহণ করে তামাক চাষ করে চাষিরা।
লামার শিলের তোয়া মারমা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নূনার বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাবেক বিলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লাইনঝিড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছাগলখাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাইল্যাচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ম্যাওলাচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে তামাক চাষ হচ্ছে।
আলিকদম উপজেলার নয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাংতাই হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাং চিং হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ এবং চক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের পাশে গড়ে উঠেছে তামাকের বাগান। এর বাইরেও অনেক সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আছে একরের পর একর তামাকের বিশাল বাগান।
এদিকে চাষিদের যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে সজাগ থাকেন তামাক প্রতিষ্ঠান চাষিদের সুবিধার জন্য ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা।
লামা পৌরসভা এলাকার ছাগলখাইয়া গ্রামের চাষি মোবারক হোসেন ও সদর ইউনিয়নের মেরাখোলার চাষি নজির আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ফসল চাষের শুরুতে তারা অর্থসংকটে ভোগেন। এ সুযোগে তামাক প্রতিষ্ঠানগুলো চাষিদের মধ্যে কার্ড দিয়ে বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করে এবং কোনও শর্ত ছাড়াই ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেয়। সেই সঙ্গে প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন তারা। তামাক কেনার শতভাগ নিশ্চয়তাও পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে।
এদিক দিয়ে পিছিয়ে সরকারের কৃষি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। সবজি ক্ষেত নষ্ট হলেও বেশিরভাগ সময় সরকারি লোকজনকে পাওয়া যায় না। অবশ্য লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু চাষিরা অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।’
বান্দরবানে তামাক চাষের চিত্রবান্দরবানে তামাক চাষের চিত্র
রূপসীপাড়া ইউনিয়নের দরদরী গণমাস্টার পাড়ার চাষি শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সবজি চাষে খরচের তুলনায় মুনাফা কম, কিন্তু তামাক চাষে মুনাফা বেশি। তাই দিন দিন তামাক চাষির সংখ্যা বাড়ছে। তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় নারী ও শিশু-কিশোরসহ পরিবারের সবাই সমানভাবে কাজ করছেন তামাক ক্ষেতে।
লামার ছাগলখাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী বিলকিছ আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতি বছর তামাক বিক্রির টাকায় নতুন পোশাক কিনে দেন বাবা-মা। তাই তামাক পাতার গন্ধ ভালো না লাগলেও তামাক ক্ষেতে কাজ করি।’
আরও জানা গেছে, দিনভর তামাক ক্ষেতে কাজ করে নারী শ্রমিকরা মজুরি পায় মাত্র দেড়শ’ টাকা। বিকল্প কোনও কর্মসংস্থান না থাকায় অল্প বেতনে তামাক ক্ষেতেই কাজ করতে হচ্ছে তাদের। তামাক পরিচর্যা করার সময় মাঝে মধ্যে পাতার বিষাক্ত গ্যাসে তাদের বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘোরে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শফিউর রহমান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, তামাক শোধনের সময় নির্গত নিকোটিনের কারণে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
Source: banglatribune,March 11, 2017